অশোক (সম্রাট)
অশোক | |
---|---|
'সম্রাট অশোক[১][২] | |
রাজত্ব | খ্রিস্টপূর্ব ২৬৯- খ্রিস্টপূর্ব ২৩২ |
রাজ্যাভিষেক | খ্রিস্টপূর্ব ২৬৯ |
পূর্বসূরি | বিন্দুসার |
উত্তরসূরি | দশরথ |
দাম্পত্য সঙ্গী | অসন্ধিমিত্রা দেবী কারুবকী পদ্মাবতী তিষ্যরক্ষা |
বংশধর | মহেন্দ্র (পালি:মহিন্দ) সংঘমিত্রা তিবল কুণাল চারুমতী |
রাজবংশ | মৌর্য সাম্রাজ্য |
পিতা | বিন্দুসার |
মাতা | সুভদ্রাঙ্গী |
ধর্ম | বৌদ্ধ ধর্ম |
অশোক (ব্রাহ্মী লিপি: 𑀅𑀲𑁄𑀓, সংস্কৃত: अशोक) বা মহান অশোক, গ্রিক নাম পিওদাসেস, ভারতীয় উপমহাদেশের তৃতীয় মৌর্য সম্রাট[৩] যিনি পিতা বিন্দুসারের পর সিংহাসন লাভ করেন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সম্রাট দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ ব্যতীত ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চল শাসন করেন। তাঁকে একজন "সর্বভারতীয় সম্রাট" বলা যায়। তিনি শুধু বর্তমান ভারত ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো শাসনই করেননি বরং এসব অঞ্চলের সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাম্রাজ্যের বাহিরেও তিনি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। আধুনিক যুগে জীববৈচিত্র্য রক্ষার যে মনোভাব দেখা যায় তিনি খ্রিস্টপূর্ব যুগে বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক রূপে সে ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
নাম ও উপাধিসমূহ[সম্পাদনা]
সংস্কৃত শব্দ "অশোক" অর্থ শোকবিহীন বা দুঃখহীন।সমাসগত দিক থেকে শব্দটি বহুব্রীহি।[৪] অশোকাবদান গ্রন্থানুসারে, তিনি জন্ম নিয়ে মাতার দুঃখ দূর করেছিলেন বিধায় তাঁর মাতা তাঁকে এ নাম দিয়েছিলেন।[৫]
সম্রাট অশোকের তাম্রশাসনে তাঁর "দেবনামপ্রিয়" নামটি পাওয়া যায়।তাঁর সমসাময়িক সিংহলরাজের নাম ছিল দেবনামপ্রিয় তিষ্য ( প্রকৃত পালি নাম: দেবনামপিয় তিস্স) এবং তাঁর বংশধর দশরথ মৌর্যেরও এমন নাম ছিল। তাই প্রায়ই বিভ্রান্তি হতো যে সত্যিকার অর্থেই অশোকের নাম বা উপাধি "দেবনামপ্রিয়"কিনা। তবে মাস্কি( ভারতের কর্ণাটকের স্থান) ও গুজার্রা ( মধ্যপ্রদেশ) অঞ্চলে প্রাপ্ত শিলালিপিতে অশোক ও দেবনামপ্রিয়কে একই ব্যক্তি বলে অভিহিত করেছে।দেবনামপ্রিয় (পালি:দেবনামপিয়) সংস্কৃত শব্দটির অর্থ দেবতাদের নাম যাঁর প্রিয় অথবা যিনি দেবতাদের প্রিয়।
তৃতীয়-চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের পালি গ্রন্থ দীপবংস সম্রাট অশোককে "পিয়দসি"( সংস্কৃত : প্রিয়দর্শী) নামে অভিহিত করেছে।ক্রূর স্বভাবের জন্য তিনি "চণ্ডাশোক" নামে পরিচিত। চণ্ড অর্থ প্রচণ্ড বা ভয়ানক।[৬] সুতরাং এ নাম দ্বারা তাঁর ভয়ানক স্বভাব প্রকাশ পাচ্ছে।
জন্ম[সম্পাদনা]
অশোকাবদান গ্রন্থানুসারে, অশোক দ্বিতীয় মৌর্য সম্রাট বিন্দুসার ও তার এক দাসীর গর্ভে(যে চম্পা নগর থেকে আগত) জন্ম নেন যে আজীবিক দার্শনিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিল[৭] ব্রাহ্মণ বংশের নারী সুভদ্রাঙ্গীর পুত্র ছিলেন।[৮] দিব্যাবদান গ্রন্থে অশোকের মাতাকে জনপদকল্যাণী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৯][১০]
সিংহাসনলাভ[সম্পাদনা]
সময়সীমা[সম্পাদনা]
দীপবংস (দীপবংশ) ও মহাবংস(মহাবংশ) গ্রন্থদ্বয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে অশোক গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর ২১৮ বছর পর সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ৩৭ বছর শাসন করেন। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞগণ বুদ্ধের মৃত্যু ৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হয়েছিল বলে ধারণা করেন। এই দুই গ্রন্থের তথ্য যদি সঠিক হয় তবে অশোক ২৬৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সিংহাসনলাভ করেছিলেন।[১১]
পুরাণে বর্ণিত হয়েছে, বিন্দুসার ২৫ বছর সাম্রাজ্য শাসন করেছিলেন(দীপবংস ও মহাবংসে বর্ণিত ২৮ বছর পুরাণমতে সঠিক নয়)।এটি সঠিক হলে অশোক ২৬৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সিংহাসনলাভ করেছিলেন।[১২] যদি ধরে নেওয়া হয় গৌতম বুদ্ধ ৪৮৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মৃত্যুবরণ করেন তাহলেই একমাত্র পুরাণের সঙ্গে মহাবংস ও দীপবংসের বর্ণনা মিলে যায়। কারণ ৪৮৬ থেকে ২১৮ বিয়োগ করলে ২৬৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ হবে।
উত্তর ভারতীয় বিবরণীগুলো অশোকের রাজ্যাভিষেক বুদ্ধের মৃত্যুর শতবর্ষ পর হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছে যা উপর্যুক্ত কোনো বিবরণের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়।
অভিষেক[সম্পাদনা]
ঐতিহাসিক সূত্রগুলো কখনো অশোককে তাঁর পিতার রাজত্বকালে যুবরাজ রূপে উল্লেখ করেনি। তথাপি তিনি সিংহাসনে আরোহণ করতে সমর্থ হন।
বিন্দুসার তার অপর পুত্র সুসীমকে উত্তরাধিকারী রূপে চেয়েছিলেন, কিন্তু সুসীমকে উগ্র ও অহঙ্কারী চরিত্রের মানুষ রূপে বিবেচনা করে বিন্দুসারের মন্ত্রীরা অশোককে সমর্থন করেন।[১৩]
এরপর তক্ষশীলায় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আরম্ভ হলে বিন্দুসার পুত্র সুসীমকে তা দমনের জন্য প্রেরণ করেন।সুসীম বিদ্রোহ দমনে অসমর্থ হন এবং বিন্দুসার অশোককে বিদ্রোহ দমন করতে তক্ষশীলায় যেতে বলেন।[১৪] বিন্দুসার অসুস্থ ও মুমূর্ষু ছিলেন এবং মন্ত্রীগণ সাময়িকভাবে অশোককে সিংহাসনে অভিষিক্ত করার জন্য পরামর্শ দেন।[১৫] তখন তিনি সুসীম তক্ষশীলা থেকে না আসা পর্যন্ত কাউকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করতে অসম্মতি জানান। শীঘ্রই বিন্দুসারের মৃত্যু হয় এবং অশোকের রাজ্যাভিষেক হয়।
রাধাগুপ্ত নামক এক মন্ত্রী অশোকের সিংহাসনলাভের পক্ষে প্রধান সহায়ক হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর প্রধানমন্ত্রী রূপে দায়িত্ব পালন করেন।যখন সুসীম ফিরে আসে ;রাধাগুপ্ত শঠতা করে সুসীমকে একটি জ্বলন্ত কয়লা ভর্তি গর্তে ফেলে দিয়ে হত্যা করেন এবং সুসীমের সেনাপতি ভদ্রযুদ্ধ বৌদ্ধ সাধু রূপে জীবনযাপন করতে থাকে।[১৬]
মহাবংশের বর্ণনা কিছুটা ভিন্ন।মহাবংশে উল্লেখ করা হয়েছে, অশোক মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক রাজধানী উজ্জয়নী থেকে এসে সিংহাসনে আরোহণ করেন।[১৭]
কিংবদন্তি[সম্পাদনা]
অশোকাবদান গ্রন্থানুসারে,সুসীম বিদ্রুপ করে একবার এক টেকো মন্ত্রীর মাথায় চাটি মেরেছিলেন।তাই টেকো মন্ত্রী ভাবলেন, সম্রাট না হতেই যিনি আমার মাথায় চাটি মারতে পারেন নিশ্চিতভাবেই সম্রাট হয়ে একদিন ঠাট্টা করে আমাকে তরবারি দিয়ে আঘাত করতেও দ্বিধা করবেন না।এ কারণে তিনি সাম্রাজ্যের পাঁচশত মন্ত্রীকে সংঘবদ্ধ করেন যেন পরবর্তীতে রাজকুমার অশোককে সিংহাসনে অভিষিক্ত করতে পারেন। অশোকাবদানে গল্পের মতো ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। তবে এটি বাস্তবভিত্তিক ঘটনাকেই নির্দেশ করে বলে প্রতীয়মান হয় যদিও এতে সাহিত্যরস যোগ করা হয়েছে।
পুরাণমতে, অশোককে দেবতারা সহায়তা করেন।ফলে বিন্দুসারের মৃত্যু হয় এবং অশোকের রাজত্ব যক্ষপুরী থেকে নাগলোক পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।[১৪]
সাম্রাজ্য বিস্তার[সম্পাদনা]
পিতা বিন্দুসার ও পিতামহ চন্দ্রগুপ্তের রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যের আয়তন, সামরিক শক্তি ও সমৃদ্ধি অশোক বহুগুণে বৃদ্ধি করেছিলেন। সিংহাসনে আরোহণ করে অশোক পরবর্তী আট বছর তার সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। উত্তরে হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে শুরু করে দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ বাদ দিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ তার করায়ত্ত হয়।[১০] অর্থাৎ তাঁর রাজত্ব বর্তমান ভারত , পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অধিকাংশ, বাংলাদেশ এবং আনুমানিক নেপালের কিয়দংশেও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর রাজত্বকালের অষ্টম বর্ষে তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। এই ভয়াবহ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ মানুষ নিহত এবং দেড় লক্ষ মানুষ নির্বাসিত হয়েছিল।[১৮][১৯]
প্রাথমিক শাসনকাল[সম্পাদনা]
সম্রাট অশোককে অধিকাংশ গ্রন্থই তাঁর শাসনকালের প্রাথমিক কালে অত্যাচারী ও ক্রূর রূপে উল্লেখ করেছে।সিংহলী ও উত্তর ভারতীয় বিবরণীগুলো অশোককে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পূর্বে নৃশংস শাসক রূপে বর্ণনা করেছে। কখনো কখনো অশোককে কামুক স্বভাবের জন্য কামাশোক বলা হতো।
অশোকাবদান গ্রন্থেও তাঁর এমন আচরণের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হয়েছে।
•অশোককে সিংহাসনলাভে যে সকল মন্ত্রীরা সাহায্য করেছিলেন অশোক তাঁদের আনুগত্য অক্ষুণ্ন আছে কিনা তা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি মন্ত্রীদের সাম্রাজ্যের সব ফলদ ও সপুষ্পক বৃক্ষ কর্তনের আদেশ দিলেন। কিন্তু মন্ত্রীরা এমন নির্বোধের মতো কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। এতে তিনি ৫০০ মন্ত্রীর শিরশ্ছেদ করলেন।[২০]
•বাহির থেকে দেখতে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন কিন্তু ভিতরে ভয়ানক অত্যাচারের জন্য তিনি রাজধানী পাটলীপুত্রে এক কারাগার নির্মাণ করেন। ভয়াবহতার জন্য একে অশোকের নরক বলা হতো।[২১] সপ্তম শতাব্দীর চীনদেশীয় পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এমন স্তম্ভের কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে অশোকের নরক চিহ্নিত হয়েছে।[২২] একবার মগধের গ্রামের এক বালক "গিরিক" গর্ব করে বলল সে পুরো জম্বুদ্বীপের (ভারত অথবা এশিয়া বুঝিয়েছে) দায়িত্ব নিতে পারে। অশোকের মন্ত্রী রাধাগুপ্ত গিরিকের কথা জানতে পারলেন এবং তাঁকে ভাড়া করে আনা হলো। তাঁকে কারাগারে অত্যাচার করার জন্য নিয়োগ দেয়া হলো। সে সম্রাটের আদেশে বন্দীদের পাশবিক নির্যাতন করত। [২৩]
•অশোক একবার তাঁর উপপত্নীদের নিয়ে বিহার করছিলেন। তখন উদ্যানে তারা একটি সুন্দর অশোক বৃক্ষ দেখতে পান। তবে অশোক তাঁর রুক্ষ ত্বকের জন্য উপপত্নীদের কাছে অপ্রিয় ছিলেন। অশোক ঘুমিয়ে গেলে অশোকের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ স্বরূপ তারা ঐ সুন্দর অশোক বৃক্ষকে নষ্ট করে দেয়। সম্রাট একে নিজের অপমান মনে করে উপপত্নীদের অগ্নিদগ্ধ করেন।[২৪]
সিংহলী বর্ণনা অনুযায়ী তিনি তাঁর ভাই বীতাশোককে ছেড়ে নিরানব্বইজন ভাইকে হত্যা করেছিলেন।[২৫] নিরানব্বই জনকে হত্যার ব্যাপারটিকে বাড়াবাড়ি গণ্য করা হয়।কারো কারো মতে,তাঁর ভাইদের অনেকেই তাঁর রাজত্বকালে জীবিত ছিল। কারণ অশোকের শিলালিপিতে পরিবারের দেখাশোনার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগের কথা বলা হয়েছে যাদের দায়িত্ব ছিল তাঁর ভাইদের স্ত্রী-সন্তানদের দেখাশোনা করা। ঐতিহাসিকদের মতে, এখানে শুধু ভাইয়ের পরিবারের কথা বলা হয়েছে ভাইদের দেখাশোনার কথা বলা হয়নি।
তবে ঐতিহাসিকগণ এসব বর্ণনাকে সম্পূর্ণ সত্য বলে মনে করেন না বরং বৌদ্ধ গ্রন্থকারদের অতিরঞ্জন বলে মনে করেন। তারা মনে করেন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পর অশোক অলৌকিকভাবে কতটা পরিবর্তিত হয়ে যান তা বোঝানোর জন্য এবং বৌদ্ধ ধর্মকে আরো বেশি মহিমান্বিত করার জন্য এমন মনগড়া কাহিনীর জন্ম দেন।
বৌদ্ধধর্ম গ্রহণোত্তর জীবন[সম্পাদনা]
অশোকের ক্রূর স্বভাবের জন্য তাকে চণ্ড অশোক নামে অভিহিত করা হত। অধ্যাপক চার্লস ড্রেকেমেয়ার অবশ্য বৌদ্ধ প্রবাদগুলিকে অতিশয়োক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তার মতে, কোপণ স্বভাবের অশোক যে বৌদ্ধ ধর্মে প্রভাবিত হয়ে একজন ধার্মিক ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন, সেই বৌদ্ধ ধর্মকে সুমহান হিসেবে দেখানোর উদ্দেশ্যে এই সমস্ত কাহিনীর জন্ম দেওয়া হয়েছিল।[২৬]
অশোকের ত্রয়োদশ শিলালিপিতে বর্ণিত হয়েছে যে কলিঙ্গের যুদ্ধে প্রচুর মানুষের মৃত্যু ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের অপরিসীম কষ্ট লক্ষ্য করে অশোক দুঃখে ও অনুশোচনায় দগ্ধ হন।[১৯][২৭][২৮] এই ভয়ানক যুদ্ধের কুফল লক্ষ্য করে যুদ্ধপ্রিয় অশোক একজন শান্তিকামী ও প্রজাহিতৈষী সম্রাট এবং বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় শুধুমাত্র মৌর্য সাম্রাজ্য নয়, এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারিত হয়।[২৯] তার পুত্র মহিন্দ ও কন্যা সংঘমিত্রা সিংহলে (শ্রীলঙ্কা) বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন।[৩০] অশোকের ধার্মিকতার দৃষ্টান্ত তাঁর প্রস্তরে উৎকীর্ণ লিপিতে পাওয়া যায়।
অশোকাবদান গ্রন্থানুসারে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার পরেও অশোক হিংসা ত্যাগ করেননি। তিনি পুণ্ড্রবর্ধন অঞ্চলে বসবাসকারী সমস্ত আজীবিক সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যার নির্দেশ দেন, যার ফলে প্রায় ১৮,০০০ মানুষ নিহত হন।[৮][৩২] এছাড়া জৈন ধর্মাবলম্বীদের ওপর তিনি হত্যা করেন বলেও কথিত রয়েছে।[৮][৩২] যদিও ঐতিহাসিকদের মতে, এই ঘটনাগুলির সত্যতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।[৩৩][৩৪]
বৈদেশিক সম্পর্ক[সম্পাদনা]
অশোকের শিলালিপিগুলোতে তার বৈদেশিক সম্পর্কের অনেক তথ্য উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বৌদ্ধধর্ম প্রসারের জন্য প্রতিবেশী শাসকদের নিকট দূত প্রেরণ করতেন। এমনকি নিজ পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রাকে শ্রীলঙ্কায় প্রেরণ করেছিলেন।
ধর্ম[সম্পাদনা]
অশোক দক্ষিণ এশিয়ায় বৌদ্ধধর্ম প্রসারের পথ প্রশস্ত করেন।তৎকালীন শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরের শাসক দেবনামপ্রিয় তিষ্য (পালি:দেবনামপিয় তিস্স) সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্রের মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। অনুরাধাপুর রাজ্যের সঙ্গে তার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। অশোকের আফগানিস্তানে প্রাপ্ত মুখ্য ত্রয়োদশ শিলালিপিতে বর্ণিত হয়েছে:
চিকিৎসা[সম্পাদনা]
তিনি তার শিলালিপিতে প্রতিবেশী রাজাদের নাম ও তাদের সঙ্গে চিকিৎসা সেবাজনিত সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেছেন , তার প্রতিবেশী শাসকদের প্রজা ও তাদের গবাদি পশু উভয়ের জন্যই চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হবে।
অন্যান্য[সম্পাদনা]
মৌর্য রাজসভায় যবন(গ্রিক) রাজদূতদের উপস্থিতি ছিল। অশোকের পিতা আর পিতামহের মতো অশোকের রাজসভায়ও তা ছিল বলে জানা যায়।দিওনিসিস হলেন মিশরের গ্রিক শাসক দ্বিতীয় টলেমি প্রেরিত রাজদূত যিনি অশোকের রাজত্বকালে মৌর্য রাজসভায় দূত ছিলেন।[৩৯] বর্তমান লিবিয়ার সিরেনাইকার দার্শনিক ইগিসিয়াস সম্ভবত অশোকের প্রচেষ্টায় বৌদ্ধধর্মের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যিনি সম্ভবত অশোকের শিলালিপিতে উক্ত মাগোসের (মাগাস) শাসনকালে বর্তমান ছিলেন।[৪০][৪১] শক রাজা রুদ্রদমনের গুজরাটের জুনাগড় শিলালিপিতে অশোকের নাম উদ্ধৃত হয়েছে।[৪২] এতে গ্রিকদের অশোকের প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানের কার্যে নিয়োগ করার উল্লেখ আছে যিনি গুজরাটের গির্নারের নিকট জলনালী নির্মাণ তত্ত্বাবধান করছিলেন।[৪৩]
স্মৃতিচিহ্ন[সম্পাদনা]
সম্রাট অশোকের কীর্তি বিভিন্ন প্রতীক,উৎকীর্ণলিপি শিল্প,মুদ্রা ইত্যাদিতে উদ্ভাসিত।অশোকের স্মৃতিচিহ্ন তাঁর সমসাময়িক ভারত, পাকিস্তান,আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও নেপালের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত।
প্রতীক[সম্পাদনা]
ভারতের জাতীয় পতাকার কেন্দ্রে স্থান পেয়েছে অশোকস্তম্ভের নিম্নস্থিত ধর্মচক্র। ভারতের পতাকা স্মরণ করিয়ে দেয় মৌর্য সাম্রাজ্যের গৌরবময় ইতিহাস।
জনপ্রিয় সংস্কৃতি[সম্পাদনা]
অশোক ছবিটিতে শাহরুখ খান , কারিনা কাপুর , অজিথ কুমার (তাঁর প্রথম এবং একমাত্র হিন্দি চলচ্চিত্রের ভূমিকায়), হৃষিতা ভট্ট , এবং ড্যানি ডেনজংপা অভিনয় করেছেন । এটি প্রযোজনা করেছেন খান, জুহি চাওলা [৪৪] ও রাধিকা সাঙ্গোই[৪৫]। চিত্রনাট্যটি লিখেছেন সন্তোষ সিভান এবং সাকেত চৌধুরী এবং সংলাপ আব্বাস টাইরেওয়ালা । এটি মূলত ভারতে অশোক দ্য গ্রেট হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল ।
চলচ্চিত্রটি ইউনাইটেড কিংডম এবং উত্তর আমেরিকা জুড়ে ব্যাপকভাবে প্রদর্শিত হয়েছিল এবং ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভাল এবং টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল যেখানে এটি ইতিবাচক সাড়া পেয়েছিল[৪৬]।
তবে ফিল্মের সমস্ত চরিত্র (মৌর্য সাম্রাজ্য এবং কলিঙ্গ থেকে) খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে প্রাচীন প্রাকৃত উপভাষার বিরোধিতা করে আধুনিক হিন্দি কথা বলে। চলচ্চিত্রের ঐতিহাসিক ব্যক্তির নামও আধুনিক হিন্দি অনুসারে পরিবর্তন করা হয়েছে।তাছাড়া ছবিতে অশোক আগ্রাশনের সময় রানীর কলিঙ্গ পরিচালনার কোন প্রমাণ নেই।দেবীর প্রতি অশোকের প্রেম ও প্রকাশ পায় নি[৪৭]।
তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]
- ↑ Lars Fogelin (১ এপ্রিল ২০১৫)। An Archaeological History of Indian Buddhism। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 81–। আইএসবিএন 978-0-19-994823-9।
- ↑ Fred Kleiner (১ জানুয়ারি ২০১৫)। Gardner’s Art through the Ages: A Global History। Cengage Learning। পৃষ্ঠা 474–। আইএসবিএন 978-1-305-54484-0।
- ↑ Chandra, Amulya (২০১৫-০৫-১৪)। "Ashoka | biography - emperor of India"। Britannica.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৮-০৯।
- ↑ বাংলা ব্যবহারিক অভিধান। বাংলা একাডেমি।
- ↑ Strong 1989, পৃ. 205।
- ↑ বাংলা ব্যাবহারিক অভিধান। বাংলা একাডেমি।
- ↑ Arthur Llewellyn Basham (১৯৫১)। History and doctrines of the Ājīvikas: a vanished Indian religion। foreword by L. D. Barnett (1 সংস্করণ)। London: Luzac। পৃষ্ঠা 138, 146। সংগ্রহের তারিখ ৮ এপ্রিল ২০১৩।
- ↑ কখ গ John S. Strong (১৯৮৯)। The Legend of King Aśoka: A Study and Translation of the Aśokāvadāna। Motilal Banarsidass Publ.। পৃষ্ঠা 232। আইএসবিএন 978-81-208-0616-0। সংগ্রহের তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০১২।
- ↑ K. T. S. Sarao (২০০৭)। A text book of the history of Theravāda Buddhism (2 সংস্করণ)। Department of Buddhist Studies, University of Delhi। পৃষ্ঠা 89। আইএসবিএন 978-81-86700-66-2।
- ↑ কখ Upinder Singh (২০০৮)। A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th century। Pearson Education। আইএসবিএন 978-81-317-1677-9।
- ↑ Thapar। ১৯৬১। পৃষ্ঠা ১৩–১৪।
- ↑ Thapar। ১৯৬১। পৃষ্ঠা ১৩।
- ↑ Gyan Swarup Gupta (১ জানুয়ারি ১৯৯৯)। India: From Indus Valley Civilisation to Mauryas। Concept Publishing Company। পৃষ্ঠা 268–। আইএসবিএন 978-81-7022-763-2। সংগ্রহের তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০১২।
- ↑ কখ Strong। ১৯৮৯। পৃষ্ঠা ২০৯।
- ↑ Lahiri। ২০১৫। পৃষ্ঠা ১০২।
- ↑ Strong। ১৯৮৯। পৃষ্ঠা ২১০।
- ↑ Lahiri। ২০১৫। পৃষ্ঠা ১০১।
- ↑ Radhakumud Mookerji (1988). Chandragupta Maurya and His Times. Motilal Banarsidass Publ. আইএসবিএন ৮১-২০৮-০৪০৫-৮.
- ↑ কখ S. Dhammika, The Edicts of King Ashoka, Kandy, Buddhist Publications Society (1994) ISBN আইএসবিএন ৯৫৫-২৪-০১০৪-৬ (on line)
- ↑ Lahiri। ২০১৫। পৃষ্ঠা ১০৫।
- ↑ Pradip Bhattacharya (২০০২)। The Unknown Ashoka।
- ↑ Thapar। ১৯৬১। পৃষ্ঠা ২৯।
- ↑ Lahiri। ২০১৫। পৃষ্ঠা ১০৬।
- ↑ Upinder Singh (২০০৮)। A History of Ancient and Medieval India: From the stone age to the 12th century। পৃষ্ঠা ৩৩২।
- ↑ Unresolved। ১৯৯৫। পৃষ্ঠা ৪৬। Authors list-এ
|প্রথমাংশ1=
এর|শেষাংশ1=
নেই (সাহায্য) - ↑ Charles Drekmeier (১৯৬২)। Kingship and Community in Early India। Stanford University Press। পৃষ্ঠা 173–। আইএসবিএন 978-0-8047-0114-3। সংগ্রহের তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০১২।
- ↑ Smith, Vincent A. (১৯০১)। Asoka - the Buddhist Emperor of India। Rulers of India series। Oxford at the Clarendon Press। পৃষ্ঠা 130।
- ↑ Kamath, Prabhakar। "How Ashoka the Great Gave Brahmins A Song With Which They Conquered India"। Nirmukta।
- ↑ Buckley, Edmund। Universal Religion। The University Association।
- ↑ "Ashoka's son took Buddhism outside India"। The Times of India।
- ↑ Upinder Singh (2008). A History of Ancient and Early Medieval India: From the Stone Age to the 12th century. Pearson Education. পৃষ্ঠা ৩৩২
- ↑ কখ Beni Madhab Barua (৫ মে ২০১০)। The Ajivikas। General Books। পৃষ্ঠা 68–69। আইএসবিএন 978-1-152-74433-2। সংগ্রহের তারিখ ৩০ অক্টোবর ২০১২।
- ↑ Steven L. Danver (২২ ডিসেম্বর ২০১০)। Popular Controversies in World History: Investigating History's Intriguing Questions: Investigating History's Intriguing Questions। ABC-CLIO। পৃষ্ঠা 99। আইএসবিএন 978-1-59884-078-0। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মে ২০১৩।
- ↑ Le Phuoc (মার্চ ২০১০)। Buddhist Architecture। Grafikol। পৃষ্ঠা 32। আইএসবিএন 978-0-9844043-0-8। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মে ২০১৩।
- ↑ Seth, H.C। Central Asiatic Provinces of the Mauryan Empire। পৃষ্ঠা ৪০২।
- ↑ Journal of the Asiatic Society ও ১৯৪০ p.১৭।
- ↑ Inscriptions of Asoka, E.Hultzsch এবং ১৯২৫ p.৪১।
- ↑ Inscriptions of Asoka. New Edition by E. Hultzsch (Sanskrit ভাষায়)। ১৯২৫। পৃষ্ঠা 3।
- ↑ Pliny the Elder, "The Natural History", 6, 21
- ↑ Preus, Anthony (২০১৫)। Historical Dictionary of Ancient Greek Philosophy। পৃষ্ঠা ১৮৪।
- ↑ Clayman, Dee L (২০১৪)। Berenice II and the golden Age of Ptolemaic Egypt। Oxford University press।
- ↑ Guha, Sudeshna (২০১৫)। Artefacts of History: Archaeology,Historigraphy and Indian pasts। Sage Publications India। পৃষ্ঠা ৫০।
- ↑ The Idea of Ancient India: Essays on Religion, Politics, and Archaeology by Upinder Singh
- ↑ "Asoka"।
- ↑ "অশোক"।