মাছের রোগ ও প্রতিকার ব্যবস্থা Common fish Diseases & Remedial Measures in Bengali




মাছের রোগ ও প্রতিকার ব্যবস্থা (Common fish Diseases & Remedial Measures)


জীবের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নির্ভর করে তার শারীরিক সবলতা ও নির্মল পরিবেশের উপর। দূষণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও হ্রাস পায় তখনই যখন জীব দুর্বল ক্ষীণজীবী হয় এবং রোগজীবাণুরা পরাক্রমী হয়ে ওঠে। মাছ জলে বাস করে। সেই জলেই তার রোগজীবাণুরাও বাস করে। জল দূষণ হলে রোগজীবাণুরাও সংখ্যায় বেড়ে যায়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মাছের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায়। মাছ আক্রান্ত হয়ে পড়ে প্রাকৃতিক কারণে মাছ অল্প দূষিত জলীয় পরিবেশ নিজেই পরিশোধিত করতে পারে। কিন্তু অতি দূষণ হলেই রোগগ্রস্থ হয়। তাই মাছচাষের জল যথাসম্ভব দূষণমুক্ত রাখতেই হবে। মাছের শরীরের একরকম কোষ, বাইরের আঁশ ও শ্লেষ্মার (Body slime) জন্য মাছ বাইরের জীবাণুর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে।

জল, মাটির দূষণে, তাপমাত্রা অতিমাত্রায় কম-বেশি হলে, পি. এইচের রকমফের হলে, জলে দ্রবীভূত অম্লজানের মাত্রা কমে বা বেশি বেড়ে গেলে চাষের জল মাছের জীবন রক্ষার প্রতিকূল হয়ে পড়ে। তাছাড়াও জলে অত্যধিক জলজ ঝাঝিপানা থাকলে, সারের মাত্রার অধিক প্রয়োগ হলে, কীটনাশক ও বিষ প্রয়োগেও মাছের জীবনচক্র নষ্ট হয়। জলাশয়। তলদেশে জৈববর্জ্যের আধিক্য হেতু, হাইড্রোজেন সালফাইড (H,S, ), অ্যামোনিয়া (NH), মিথেন (CH.) ইত্যাদির অবস্থানে, মাছ অসুস্থ ও দূর্বল হয়। অতিরিক্ত মাছ রাখা ও বাইরের নোংরা জল চাষের পুকুরে প্রবেশ করালে মাছের রোগাক্রান্ত হবার সম্ভাবনা প্রবল। মাছ রোগাক্রান্ত হবার মূল বিষয়গুলির কথা নীচে উল্লেখ করার হল।

(ক) পরজীবী (Parasites)
শিশু ও বড় মাছ কোন কারণে আঘাত পেলে বা দেহে ক্ষত সৃষ্টি হলে সেই ক্ষতের উপর চুলের মত ছত্রাক (fungus) জন্মায়। গরমের সময় ফুলকায় আরেকরকম ব্র্যাঞ্চি মাইসিস্ ছত্রাক জন্মায়। এর প্রতিকার হলো চাষজল দূষণমুক্ত রাখা। ৩ শতাংশ লবণজল অথবা তুঁতের ০.৫ পিপিএম ও ০.৫ পিপিএম ম্যালাকাইট গ্রিন দ্রবণে ডোবালে সুফল পাওয়া যায়।
Parasites


(খ) জীবাণু (Bacteria, Virus)

মাছের পাখনা ও লেজের আগার পচন, গাড় লাল দাগ বা ছড়ে যাওয়ার মতন দাগ, উদরি বা শোথ (Dropsy), পেট ও আঁশে জল জমা, চোখ ফুলে বড় হওয়া ইত্যাদি হল জীবাণুঘটিত রোগ। জীবাণুঘটিত রোগের ক্ষেত্রে জলাশয়ের তলদেশে চুন দিয়ে পাঁক ঘেঁটে দিতে হবে। আক্রান্ত মাছ ভূতের দ্রবণে ডুবোলে এসব রোগ সেরে যায়। খাবারের সাথে জীবাণুনাশক (Anti-biotic) ১০ মিগ্রা ১ লিটার জলে মিশিয়ে খাওয়ালে ভাল হয়। ভাইরাস ঘটিত রোগের প্রতিকার জানা নেই। জলাশয় ও চারপাশের পরিবেশ চাষের উপযোগী রাখার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

Bacteria, Virus

(গ) এককোষী প্রাণী (Protozoan) 

নানা ধরনের সিলিয়া (Celia) সুতোর মত শরীর জুড়ে থাকা জীব। মিক্সোস পোরোডিয়ো (Myxos porodea) গরমে জল কমে গেলে জন্মায়। মাছের ত্বকে, পাখনায়, ধূসর রঙের ছোট ছোট গুটি হয়। কষ্টিয়া (Costea) নামে প্রাণী মাছের ত্বক নীলাভ করে ও প্রচুর শ্লেষ্মা (mucous) ক্ষরণ করায়। ট্রাইকোডিনারা সিলিয়াযুক্ত প্রাণী। এরাও বর্ষা ও শীতে ফুলকাতে বাসা করে ও প্রচুর লালা ( Slime) ক্ষরণ করিয়ে ফুলকা অকেজো করে দেয়। এসব ক্ষেত্রে মাছের মজুতের (Stock) পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া উচিত। খাবারের সঙ্গে ইস্ট (Yeast) পাউডার (১ গ্রাম প্রতি কেজি) ও জীবাণুনাশক (১০–১২ মিলিগ্রাম প্রতি কেজি খাদ্যে) মিশিয়ে খাওয়ালে উপকার পাওয়া যায়। ফরম্যালিন দ্রবণ ০.৫ মিলিমিটার প্রতি লিটারে ও অ্যাসিটিক অ্যাসিড (Acetic Acid) দ্রবণে (১ মিলিলিটার ১ লিটার জলে) ডোবালেও সংক্রমণ কমে।

(ঘ) উকুন (Lice)

আরগুলাস, লারনিয়া, এরগাসিলস ইত্যাদি উকুন জাতীয় প্রাণী প্রচণ্ড গরমে জলচর পাখি বা অন্য উভচর প্রাণী দ্বারা বাহিত হয়ে আসে। জলাশয়ের তলদেশে অত্যধিক জৈব বর্জ্য পদার্থের পচন ও বিপাকীয় পরিবেশে বংশবৃদ্ধি করে অনুকূল অবস্থায় অধিক সংখ্যায় জন্মায় ও মাছের দেহে ভর করে রক্ত শোষণ করে। ফলে মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। রাসয়ানিক কীটনাশক ব্যবহার করে সাময়িক সুফল পেলেও এদের সিস্ট বা কোকুন (Cyst) কাদায় বহুদিন বেঁচে থাকে। জন্মাবার উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই জেগে ওঠে। জল ও মাটির দূষণ রোধে মাসে মাসে চুন প্রয়োগ করে এদের দমিয়ে রাখা যায়। নইলে নির্মূল করা বেশ শক্ত। 

Lice


ক্ষতরোগ (Ulcerative Disease Syndrom )

বিগত কয়েকবছর ধরে মহামারি ক্ষতরোগের প্রকোপে মাছচাষের পুকুরের বহু মাছ উজাড় হয়ে গেছে। তবে বর্তমানে অনেকাংশেই এই রোগ প্রশমিত হয়েছে। এই রোগে প্রথমে জলাশয়ের অবাঞ্ছিত মাছ যেমন—শোল, ল্যাটা, শিঙ্গি, কই, পাঁকাল ইত্যাদি আক্রান্ত হয়ে চাষের মাছ আক্রান্ত হতো। দগদগে ঘা হতো শরীরে, এমনকি লেজ এবং শরীরের অর্ধেক মাংস খসেও যেত। CIFAX নামক দ্রবণ কেন্দ্রীয় মৎস্যবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে আবিস্কৃত হয়েছে। যার প্রয়োগে ক্ষতরোগ মহামারির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। CIFAX দ্রবণ খুবই ফলদায়ক। বলাবাহুল্য মাছের রোগ নিরাময়ের থেকে বেশি দরকার রোগ প্রতিহত বা প্রতিরোধ করা। কারণ মাছের রোগব্যাধির নিরাময়ের ব্যবস্থা প্রকৃতই বিজ্ঞানসম্মত কিনাএবং এর পরিপ্রেক্ষিতে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ সাধারণ মাছচাষির আয়ত্তাধীন কিনা অনেক প্রশ্ন এসে যায়। তবে বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তির দ্বারা জল, মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করে চাষজল দূষণমুক্ত রাখতে পারলেই মাছ রোগমুক্ত থাকবে। প্রসঙ্গক্রমে চাষির অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে ১০ কেজি ভালো মহুয়া খোল (শতক প্রতি ১ মিটার গভীরতার জন্য) বস্তায় বেঁধে রাখলে ও ০.৫ পিপিএম হারে তুঁতের দ্রবণ ছড়িয়েও রোগ প্রশমন হয়।
পরিশেষে বলা যায় কয়েকটি সাধারণ নিয়ম মানলেই মাছচাষের জল ও মাটি সহজেই দূষণ ও রোগমুক্ত রাখা সম্ভব।
• অন্যের জমি বা মাঠের ধোয়ানি জল জলাশয়ে প্রবেশ করানো যাবেনা। ক্ষেতে ব্যবহৃত কীটনাশকের পাত্র পুকুরের জলে ফেলা বা কীটনাশক ব্যবহারকারীর হাত-পা ধুতে মানা। জলাশয়ে কোনক্রমেই কীটনাশক দেওয়া যাবেনা।
• অন্যের জলাশয়ে ব্যবহৃত ভিজে জাল রোদে শুকিয়ে অথবা তুঁতের দ্রবণে (১ গ্রাম প্রতি লিটারে) শোধন করে নিজের জলাশয়ে দিতে হবে। কড়া রোদে শুকানো জালই ব্যবহার কার উচিত।
জলচর পাখি যেমন—পানকৌড়ি, বক, মাছরাঙা, পরের জলাশয়ে চরা হাঁস বা উভচর প্রাণী যেমন—ভোঁদড়, মেছো ইঁদুর, গোসাপ ইত্যাদির জলাশয়ে প্রবেশ  বন্ধ রাখতে হবে।
পরিবেশে উৎপন্ন সুস্থ, সবল, নীরোগ মাছের চারাই ব্যবহার করতে হবে। জলাশয়ের আয়তনের তুলনায় বেশি জৈবসার, রাসয়ানিক সার প্রয়োগ এবং অগণিত মাছের চারা ফেলা যাবেনা।

• মাছের বীজ, চারা জলাশয়ে ছাড়ার আগে অবশ্যই শোধন করতে হবে। 

Shaharuk Islam

Hi I am Shaharuk Islam. I enjoyed in writing articles and spread knowledge cross over the internet.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

Ad

Magspot Blogger Template

Ad

amazon.in
amazon.in

نموذج الاتصال