• সংজ্ঞা (Definition) : এককোশী আণুবীক্ষণিক প্রাণিদের প্রোটোজোয়া বা আদ্যপ্রাণী বলা হয়।
স্ত্রী-অ্যানোফিলিস এই পরজীবীর বাহক। ম্যালেরিয়া জ্বরের প্রধান লক্ষণ হল কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা, উচ্চ তাপমাত্রা এবং ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যাওয়া। এই জ্বরের তিনটি অবস্থা হল কম্পন অবস্থা, জ্বরাবস্থা এবং ঘর্মবস্থা। সিঙ্কোনা গাছের উপক্ষার থেকে প্রাপ্ত কুইনাইন হল এই জ্বরের প্রতিষেধক ও নিরামক ঔষধ। 1880 খ্রিস্টাব্দে ফরাসী বিজ্ঞানী ল্যাভেরান (Laveran) প্রথম মানুষের রক্তে ম্যালেরিয়া পরজীবীর উপস্থিতি লক্ষ করেন। 1898 খ্রিস্টাব্দে রোনাল্ড রস (Ronald Ross) কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন এবং তদানীন্তন প্রেসিডেন্সী জেনারেল হাসপাতালে গবেষণা করে পাখির ম্যালেরিয়ায় অ্যানোফিলিস মশকীর ভূমিকা নির্ণয় করেন। রোনাল্ড রস তার ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত কাজের জন্য (ম্যালেরিয়া পরজীবী আবিষ্কার এবং রোগবিস্তারে মশকীর ভূমিকা) 1902 খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পান।
এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা (Entamoeba histolytica) : মানবদেহের বৃহদন্ত্রে বসবাসকারী একরকমের ক্ষতিকর প্রোটোজোয়া। এটি মানবদেহে উদরাময়, আমাশয়, লিভার অ্যাবসেস, হেপাটাইটিস ইত্যাদি রোগ সৃষ্টি করে। এন্টামিবা-সংক্রামিত রোগকে সাধারণভাবে অ্যামিবিয়েসিস ( Amoebiasis) বলে। এন্টামিবা পোষকদের বৃহদন্ত্রে ক্ষত সৃষ্টি করে; ফলে মলের সঙ্গে পুঁজ ও রক্ত এবং মিউকাস নির্গত হয়। তখন রোগী এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা বারে বারে মলত্যাগ করে এবং মলত্যাগের সময় পেটে ব্যথা অনুভব করে। অনেক সময় রোগীর জ্বরও হতে পারে। এই লক্ষণগুলিকেই একসাথে আমাশয় রোগ আখ্যা দেওয়া হয়।
ক্ষতিকর প্রোটোজোয়া (Pathogenic Protozoa) :→ আদ্যপ্রাণীদের মধ্যে কিছু প্রাণী মানবদেহে পরজীবীরূপে বসবাস করে এবং নানারকম রোগ সৃষ্টি করে। এখানে কয়েকটি আদ্যপ্রাণীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় উল্লেখ করা হল :
ম্যালেরিয়া পরজীবী (Malarial parasite): প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাক্স (Plasmodium vivax) নামে একরকমের আদ্যপ্রাণী (protozoa) হল ম্যালেরিয়া রোগ সৃষ্টিকারী পরজীবী প্রাণী। এরা অন্তঃকোশীয় (interacellular) হওয়ায় অন্তঃপরজীবী (endoparasite) হিসেবে মানবদেহের যকৃৎ-কোশ বা লোহিত রক্তকণিকায় বসবাস করে এবং মানবদেহে ও অন্যান্য প্রাণীদেহে ম্যালেরিয়া রোগ সৃষ্টি করে। এদের অযৌন দশা মানবদেহে এবং যৌন দশা স্ত্রী-অ্যানোফিলিস মশার দেহে সম্পন্ন হয়।
রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুদের সংক্রমণের ধরণ বিভিন্ন রকম হতে পারে। মানবদেহে খাদ্যের সাথে, জলের সাথে, বাতাসের মাধ্যমে, বিভিন্ন পতঙ্গ অথবা অপর জীবের দেহের সাথে সংলগ্ন হয়ে অথবা তাদের দংশনের মাধ্যমে জীবাণু সংক্রমণ হয়। এছাড়াও রোগাক্রান্ত অথবা প্রাণীর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ এবং আক্রান্ত পোষাকের দ্বারা সংক্রামিত অপ্রাণীবাচক পদার্থের মাধ্যমে।
পতঙ্গ বাহকের মাধ্যমে সংক্রামিত রোগসমূহঃ
আর্থোপোডা পর্বের পতঙ্গ শ্রেণির অন্তর্গত বিভিন্ন প্রাণীর মাধ্যমে বিভিন্ন সংক্রমক রোগ ছড়ায়। এই প্রাণীগুলিকে ঐ সব রোগের বাহকরূপে গণ্য করা যেতে পারে। মানবরোগ সংক্রামনের উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ বাহক হল মাছি, মশা।
* মাছি (House fly ) : মাছির জীবনচক্রে ডিম, লাভা, পিউপা এবং পূর্ণাঙ্গ এই চারটি দশা পাওয়া যায়। পরিণত মাছি ধূসর বর্ণের এবং প্রায় 6.5 mm লম্বা। এদের দেহ, মস্তক, বক্ষ এবং উদরে বিভক্ত। মস্তকে একজোড়া শৃঙ্গ, একজোড়া পুঞ্জাক্ষি এবং খাদ্যশোষণের জন্য একটি চোষক নল বা প্রোবোসিস্ থাকে। উদর অংশটি খণ্ড বিশিষ্ট এবং হাল্কা ও গাঢ় ডোরাযুক্ত।
মাছি |
[I] রোগ বিস্তারে মাছির ভূমিকা : মাছি যখন রোগির মল-মূত্র বা বমির ওপর বসে, তখন তাদের গায়ে, পায়ে এবং ডানায় রোগজীবাণু ছড়িয়ে যায়। পরে যখন আঢাকা খাবারের ওপর বসে, তখন ঐসব রোগজীবাণু খাবারে মিশে যায় এবং সেই খাবার খেয়ে আমরা রোগাক্রান্ত হই। মাছির মাধ্যমে সংক্রামিত উল্লেখযোগ্য রোগগুলি হল— কলেরা, উদরাময়, আমাশয়, আন্ত্রিক, জ্বর, যক্ষা, কুষ্ঠ, আনথ্রাক্স, পোলিও, ক্ষতে সংক্রমণ খাদ্যে বিষক্রিয়া, সংক্রামক হেপাটাইটিস ইত্যাদি।
[2] মাছি দমনের উপায় : যেহেতু মাছি ক্ষতিকর প্রাণী, তাই এদের দমন করা একান্ত প্রয়োজন।মাছি দমনের উপায়গুলি হল :
1. মাছির বংশবৃদ্ধি রোধ করার জন্য মল, মূত্র, গোবর, ঘোড়ার বিষ্ঠা, নোংরা আবর্জনা প্রভৃতি যাতে জমে উঠতে না পারে, সেইজন্য লোকালয় থেকে দূরে নির্দিষ্ট স্থানে ঐগুলোকে নিক্ষেপ করা উচিত।
2. উপদ্রুত এলাকায় নানারকম কীটনাশক ঔষধ স্প্রে করতে হবে। আবর্জনাময় স্থানে ব্রিচিং পাউডার, ফিনাইল ইত্যাদি ছড়াতে হবে।
3. মাছির উপদ্রব বাড়লে জলে ফিনাইল গুলে বারান্দা, উঠান, করিডোর ইত্যাদি মুছতে হবে।
4. খাদ্যবস্তুর ওপর যাতে মাছি বসতে না পারে, সেইজন্য খাবার সবসময় ঢেকে রাখতে হবে।
5. যেখানে সেখানে মল-মূত্র ত্যাগ, কফ, থুতু ইত্যাদি ফেলা চলবে না।
• মশা (Mosquito) : মশা সন্দ্বিপদ পর্বের অন্তর্ভুক্ত পতঙ্গ শ্রেণির অন্তর্গত একরকমের অনিষ্টকারী পতঙ্গ। আমাদের দেশে প্রধানত তিন রকমের মশা দেখা যায়, যেমন : অ্যানোফিলিস (Anopheles), কিউলেক্স (Culex) এবং এডিস (Aedes ) । এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, কেবলমাত্র স্ত্রী মশারাই রোগজীবাণু বহন করে।
[1] রোগ বিস্তারে মশার ভূমিকা : স্ত্রী-মশা যখন রোগীর দেহ থেকে রক্ত পান করে, তখন রোগজীবাণু রোগীর দেহ থেকে মশার দেহে আসে। রোগজীবাণু বহনকারী মশা যখন সুস্থ মানুষের রক্ত পান করে, তখন ঐ রোগজীবাণু সুস্থ মানুষের রক্তে মিশে যায়। এইভাবে মশা এক মানুষের দেহ থেকে অন্য মানুষের দেহে রোগ বিস্তার করে।
মশা যে সব রোগ-জীবাণু বহন করে সেগুলি হল :
1. অ্যানোফিলিস-ম্যালেরিয়া।
2. কিউলেক্স— গোদ, এনকেফালাইটিস।
3. এডিস— ডেঙ্গু পীতজ্বর, জাপানি-বি-এনকেফালাইটিস।
মশা দমনের উপায় :
1. বাড়ির আশ-পাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।
2. উপদ্রুত এলাকায় বিভিন্ন রকম কীটনাশক ওষুধ—বেগন, ফ্লিট ইত্যাদি স্প্রে করে পূর্ণাঙ্গ মশা ধ্বংস করা।
3. ছোটখাট পুকুর, ডোবা প্রভৃতির গর্ত বুজিয়ে ফেলা এবং নর্দমা পরিষ্কার রাখা।
4. মশার প্রজনন স্থানে তেল ঢেলে বা কীটনাশক ওষুধ ছিটিয়ে মশার ডিম, লার্ভা, পিউপা ইত্যাদি ধ্বংস করা।
5. পুকুরে মশার লার্ভা ভক্ষণকারী মাছ, যেমন— তেচোখা, খলসে, তেলাপিয়া, গাপ্পি প্রভৃতি মাছ পোষা উচিত। এছাড়াও 6. রাত্রে মশারি খাটিয়ে শোয়া দরকার। মশা তাড়ানোর জন্য ধূপ-ধুনো এবং ওডোমস, ম্যাট ও রিপ্লেক্স জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করা উচিত।
বিভিন্ন রোগ-জীবাণু প্রতিরোধের জন্য নানা ধরনের জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয়। সাধারণ জীবাণুনাশকগুলি প্রধানত তিন ধরনের হতে পারে, যেমন : প্রাকৃতিক (Natural), ভৌত (Physical), এবং রাসায়নিক (Chemical) |
(1) প্রাকৃতিক জীবাণুনাশক : সূর্যালোক এবং বাতাস স্বাভাবিক জীবাণুনাশ হিসেবে কাজ করে। সূর্যালোকের অতিবেগুনি রশ্মির (Ultra violet rays) জীবাণুনাশ করার ক্ষমতা আছে।
(2) ভৌত জীবাণুনাশক : সংক্রামক রোগের জীবাণুযুক্ত জামা-কাপড় বিছানা ইত্যাদি পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে জীবাণুনাশ করা যায়। এছাড়া গরম জলে ফুটিয়ে অথবা গরম বাষ্প প্রবাহিত করেও জীবাণুনাশ করা সম্ভব হয়।
(3) রাসায়নিক জীবাণুনাশক : বাড়ি, হাসপাতাল ইত্যাদি স্থানে বিভিন্ন রাসায়নিক জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয়, যথা : মার্কারি পারক্লোরাইড, মারকিউরিক আয়োডাইড, ফেনল বা কার্বলিক অ্যাসিড, লাইসল, ফিনাইল, ব্লিচিং পাউডার, পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, ক্লোরিন, সাবান ইত্যাদি।