গলদা চিংড়ি ও বাগদা চিংড়ি চাষের আধুনিক পদ্ধতি/Modern Methods of Lobster and Prawn Farming

**চিংড়ি চাষ** (Shrimp farming) is an aquaculture activity that involves the cultivation of shrimp in controlled environments like ponds, tanks, or coastal areas. This practice is especially prevalent in countries like Bangladesh, India, Thailand, and Vietnam due to their extensive coastal regions and favorable climatic conditions. 

Shrimp farming
Shrimp farming

গলদা চিংড়ি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চাষযোগ্য জলজ প্রাণী। স্বাদুজলে যত প্রকার চিংড়ি পাওয়া যায় গলদা চিংড়ি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রজাতির চিংড়ি। গলদা চিংড়ির বৃদ্ধির হার বেশি এবং রোগেও কম আক্রান্ত হয়। এরা সহজেই অন্য মাছের সঙ্গে সহাবস্থানে এবং পরিপূরক বা কৃত্রিম খাদ্যগ্রহণে অভ্যস্ত হয়। অন্যদিকে গলদা চিংড়ির স্বাদ ও পুষ্টিমূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় দেশীয়ও বৈদেশিক বাজারে এর চাহিদা অন্যান্য মাছের তুলনায় বেশি। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী রপ্তানিপণ্য হিসাবে গলদা চিংড়ির গুরুত্ব অনেক। তাই দেশে ও বিদেশে গলদা চিংড়ি চাষের জনপ্রিয়তা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে।

গলদা চিংড়ির বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ এখনও আমাদের দেশের মৎস্য চাষীদের কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। অথচ প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সাহায্যে উন্নত প্রথায় গলদা চিংড়ি চাষ করে প্রথাগত মাছ চাষের তুলনায় অনেকগুণ বেশি লাভ করা যায়। গলদা চিংড়ি ঈষৎ নোনাজলে ও স্বাদুজলে বসবাস করতে সক্ষম। নদী, খাল, বিল, পুকুর, ছোট ডোবায় এমনকি ধানক্ষেতেও গলদা চিংড়ি পাওয়া যায়। তাই, গলদা চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতা কম। তবে, গলদা চিংড়ি খুব পরিবেশ সংবেদনশীল হওয়ায় চাষের জায়গা নির্বাচনের উপর সাফল্য নির্ভর করে।

চাষ পদ্ধতি: 

গলদা চিংড়ি সনাতনী, উন্নত হালকা, আধানিবিড়, নিবিড় ও অতিনিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। চাষের পদ্ধতিগত উন্নয়নের সঙ্গে চাষের মূলধনী খরচ ও পরিচালন খরচ বাড়ে এবং লাভও বাড়ে। তবে আমাদের দেশে বেশিরভাগ মৎস্য চাষী প্রান্তিক বা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হওয়ায় আধানিবিড় পদ্ধতিতে চাষ করা তাদের পক্ষে সহায়ক। এতে ঝুঁকি কম ও লাভজনক হয়।

(১) পুকুর নির্বাচন: গলদা চিংড়ি চাষের জন্য স্থান ও পুকুর নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগোলিক অবস্থান, মাটির প্রকৃতি ও জলের উৎস ইত্যাদি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। যেখানে জলের প্রাকৃতিক উৎস (যেমন-নদী, খাল, বিল, হ্রদ ইত্যাদি) বা গভীর অথবা অগভীর নলকূপ থেকে প্রয়োজনভিত্তিক দূষণমুক্ত জল পরিবর্তনের সুবিধা পাওয়া সম্ভব সেখানে সহজেই গলদা চিংড়ি চাষ করা যায়। তবে বন্যার জল ও নোংরা জল চাষের পুকুরে যেন কিছুতেই প্রবেশ করতে না পারে। ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুতের সুবিধা থাকলে ঝুঁকি অনেক কম হয়। সাধারণতঃ ঈষৎ পলিযুক্ত বেলেমাটি (কাদার ভাগ ৬০ শতাংশের কম)-র পুকুর গলদা চিংড়ি চাষের জন্য আদর্শ। বেলে-দোআঁশ বা বেলে-এঁটেল-দোআঁশ মাটি (জলধারণ ক্ষমতা ৮৫ শতাংশ)-তে গলদা চিংড়ির চাষ ভাল হয়। তবে পুকুরে পাঁক (১ ফুটের কম) ও পচনশীল জৈব পদার্থ কম থাকলে ভাল হয়।

পুকুরের আকার, আয়তন ও গভীরতা: সাধারণতঃ আয়তাকার পুকুর (দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ২.৫:১) গলদা চিংড়ি চাষের পক্ষে আদর্শ। তবে পুকুরের দৈর্ঘ্য হাওয়ার গতির অভিমুখ বরাবর হলে ভাল হয়। পুকুরের আয়তন কমপক্ষে ১ বিঘা ও বেশি ৫ বিঘা হলে ভাল হয়। তবে ৫ বিঘার বড় পুকুরেও গলদা চিংড়ি চাষ করা সম্ভব। যেহেতু গলদা চিংড়ি চাষের জন্য ব্যবস্থাপনা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই ব্যবস্থাপনার বিষয় বিবেচনা করে বড় আয়তনের পুকুর (সর্বাধিক ১.৬ হেক্টর) নির্বাচন করা প্রয়োজন। পুকুরের জলের গভীরতা ২.৫-৫ ফুটের মধ্যে হলে ভাল  হয়। জলের গভীরতা খুব কম (১.৫ ফুট) বা খুব বেশি (৬ ফুট) হওয়া উচিত নয়। তবে একদিকে ঢালসহ জল নিষ্কাশন সুবিধাবিশিষ্ট পুকুর গলদা চিংড়ি চাষের জন্য আদর্শ।

(২) পুকুর চিংড়ি চাষের উপযোগী করা: পুকুরে গলদা চিংড়ির চারা মজুত করার আগে পুকুরের প্রস্তুতি প্রয়োজন। এজন্য পুকুরের জল শুকিয়ে লাঙল দিয়ে চষে দু' সপ্তাহ রোদে ভাল করে শুকিয়ে নিলে ভাল হয়। তারপর মাটির পি.এইচ. অনুযায়ী পাথুরে চুন বিঘা প্রতি ২৫-৪০ কিলোগ্রাম প্রয়োগ করে অল্প জল দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হয় এবং ২-৩ দিন পর কাঁচা গোবর বিঘা প্রতি ১০০-১৫০ কিলোগ্রাম প্রয়োগ করতে হয়। কয়েকদিন পর বিঘা প্রতি ১০-১৫ কিলোগ্রাম সিঙ্গল সুপার ফসফেট প্রয়োগ করতে হয়। তারপর প্রয়োজনমত জল দিয়ে জলের গভীরতা ৩-৫ ফুট করতে হয়। ৭-১০ দিনের মধ্যে পুকুরে গলদা চিংড়ির চারা মজুতের উপযোগী হয়।

গলদা চিংড়ির বৈশিষ্ট্য হল প্রত্যেকের বসবাসের নিজস্ব এলাকায় বিচরণ করা।এরা মূলত মাংসাশী ও এদের মধ্যে আন্তঃপ্রজাতিক খাদ্য-খাদক সম্পর্ক আছে।নির্দিষ্ট সময় অন্তর এদের খোলস ত্যাগ করার সময় এরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়ে তখন অন্য চিংড়ির হাত থেকে বাঁচতে সুরক্ষিত আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়। এই আশ্রয়ের ব্যবস্থা না করলে চিংড়ির মৃত্যুর হার অনেক বেশি হয়। পুকুরের অপেক্ষাকৃত অগভীর অঞ্চলে মাটির পাত্র বা টালির ভাঙা অংশ, গাছের ডালপালা,পুরনো রবারের টায়ার অথবা পাথর স্তূপাকার করে দিতে হয়।

(৩) চিংড়ির চারা মজুত করা:গলদা চিংড়ি চাষ শুরু করার আগে গলদা চিংড়ি ও তার চারা চেনার সহজ উপায় জানা প্রয়োজন। পূর্ণাঙ্গ গলদা চিংড়ি হালকা নীল বা হালকা নীলাভ-সবুজ রঙের হয়। এদের উদর খোলসের সংযোগস্থলে নীল বন্ধনী থাকে এবং দ্বিতীয় উদর খণ্ডকের খোলস প্রথম ও তৃতীয় উদর খণ্ডকের খোলস দুটিকে আংশিক ঢেকে রাখে আর দ্বিতীয় চলন পদ বড় ও সাঁড়াশিযুক্ত নীলাভ-কালচে রঙের হয়। গলদা চিংড়ির চারার শিরোবক্ষ খোলসে লম্বালম্বি ৬-৮টি কালো দাগ বা রেখা দেখা যায়। চারা আকারে বড় হলে উদর খণ্ডকের সংযোগস্থলে নীল রঙের ডোরাকাটা দাগ দেখা যায়।

একক প্রজাতির আধানিবিড় চাষের জন্য বিঘা প্রতি ৪০০০-৭০০০ সংখ্যক চারা মজুত করতে হয়। কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন ও ভাল মানের কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলে মজুত সংখ্যা বিঘা প্রতি ১২০০০ পর্যন্ত করা যায়। একই বয়সের ও আকৃতির চিংড়ির চারা ভোরে নতুবা সন্ধ্যায় পুকুরের জলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে মজুত করতে হয়।

(৪) পরিচালন ব্যবস্থা:গলদা চিংড়ি খুব পরিবেশ সংবেদনশীল। পুকুরের পরিবেশের সামান্য তারতম্যে এদের মড়ক দেখা দেয়। তাই গলদা চিংড়ির চারা মজুত করার পর পরিচালন ব্যবস্থার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়। পুকুরের ব্যবস্থাপনার উপর চাষের সাফল্য নির্ভর করে। ব্যবস্থাপনার পর্যায়গুলো হল- সার প্রয়োগ: গলদা চিংড়ি চাষের পুকুরে নিয়মিত চুন ও সার প্রয়োগ করতে হয়। এতে পুকুরে চিংড়ির প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হয় ও পুকুরের জলের আলোক ভেদ্যতা (১-২ ফুট) নিয়ন্ত্রিত হয়। সাধারণতঃ প্রতি মাসে বিঘা প্রতি কলিচুন ৩-৫ কিলোগ্রাম, কাঁচা গোবর ১০০-১৫০ কিলোগ্রাম, বা পোলট্রি সার ৫০-৭৫ কিলোগ্রাম ও সিঙ্গল সুপার ফসফেট ৫০০ গ্রাম-১ কিলোগ্রাম প্রয়োগ করতে হয়। চুন প্রয়োগের অন্ততঃ ৭ দিন পর সিঙ্গল সুপার ফসফেট প্রয়োগ করতে হয়। তবে পুকুরের উর্বরতা বেশি অর্থাৎ আলোকভেদ্যতা ১ ফুটের কম হলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হয়। 

খাদ্য পরিবেশন: চিংড়ি নিশাচর প্রাণী। দিনেরবেলায় জলের গভীরে কোন আশ্রয়স্থলে থাকে আর রাতে খাদ্যের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। গলদা চিংড়ি সর্বভুক, প্রধান খাদ্য হল-শ্যাওলা, জলজ উদ্ভিদ, ছোট ছোট পোকামাকড়, উদ্ভিদ ও প্রাণীকণা ইত্যাদি।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষের জন্য অধিকসংখ্যায় চারা মজুত করায় পুকুরে উৎপাদিত প্রাকৃতিক খাদ্য তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়। এরা দলবদ্ধ থাকলেও এদের মধ্যে আন্তঃপ্রজাতিক প্রতিযোগিতা দেখা যায় এবং খাদ্যের অভাব হলে বাঁচার হার খুব কমে যায়। তাই শতকরা ৩০-৩৫ ভাগ প্রোটিনবিশিষ্ট পরিপুরক বা কৃত্রিম খাদ্য প্রয়োগ করা জরুরি।

খাদ্যের উপাদান হিসাবে ১ ভাগ উদ্ভিজ্জ পদার্থ (চালের খুদ, ডালের ভূষি, আটা, বাদাম বা সয়াবিন খোল ইত্যাদি) ও ৩ ভাগ প্রাণীজ পদার্থ (ফিসমিল, রেশম কীটের গুঁড়ো, ঝিনুক, শামুক বা গুগলির মাংস ইত্যাদি) মিশিয়ে তৈরি পরিপূরক খাদ্য দৈনিক চিংড়ির ওজনের ৩-২০ শতাংশ হারে প্রয়োগ করতে হয়। এই পরিপুরক খাদ্য সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে ৩-৪ কিলোগ্রামে ১ কিলোগ্রাম চিংড়ি উৎপাদন হয়।

আদর্শ কৃত্রিম খাদ্য প্রয়োগ করলে চিংড়ির বৃদ্ধি খুব ভাল হয়। সাধারণতঃ ২কিলোগ্রাম কৃত্রিম খাদ্য প্রয়োগ করে ১ কিলোগ্রাম চিংড়ি উৎপাদন হয়। চিংড়ির বয়স ও দেহ ওজনের উপর খাদ্য পরিবেশনের মাত্রা নির্ভর করে।

আদর্শ কৃত্রিম খাদ্য প্রয়োগ

জলের প্রকৃতি ও গুণমান নিয়ন্ত্রণ: বেশি ক্ষারীয় (পি.এইচ. ৮.৫-র বেশি) বা অম্লীয় (পি.এইচ. ৬.৫-র কম) জলে চিংড়ির বৃদ্ধি ভাল হয় না। জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটার জলে ৫.০ মিলিগ্রামের কম হলে মড়ক দেখা দেয়। পুকুরে চিংড়ির আদর্শ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পরিস্থিতি অনুযায়ী চুন ও সার প্রয়োগ, অক্সিজেন সরবরাহ এমনকি পুকুরের জল পরিবর্তন করতে হয়। 

চিংড়ির বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা: গলদা চিংড়ির বৃদ্ধি ও বাঁচার হার পুকুরের পরিবেশ, পুকুরের উৎপাদন ক্ষমতা, পরিপূরক বা কৃত্রিম খাদ্যের গুণগত মান ও সর্বোপরি পরিচালন ব্যবস্থার গুণগত মানের উপর নির্ভর করে। তবে একই পরিবেশে চারার বৃদ্ধি পূর্ণাঙ্গ চিংড়ির তুলনায় বেশি হয়। স্বাভাবিক বৃদ্ধি মাসে ২.৫-৫.০ মিলিলিটার পর্যন্ত হয়।

গলদা চিংড়ির রোগ ও সমস্যা

সাধারণতঃ অনুকূল পরিবেশে গলদা চিংড়ির রোগ দেখা যায় না। জল ঘোলা হয়ে গেলে, বেশি গরম হয়ে গেলে বা অক্সিজেনের ঘাটতি হলে গলদা চিংড়ির ব্যাপক মড়ক দেখা দেয়। প্রতিকূল পরিবেশ ও পুষ্টির অভাবে গলদা চিংড়ির রোগ দেখা দেয়।

(ক) কালো দাগ: লেজের কাছে বা উদর খণ্ডকের উপর কালো দাগ দেখা যায়। এটা ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ।

(খ) ফুলকা দাগ: শিরস্ত্রাণ খোলসের নীচে দু'পাশে ফুলকা প্রকোষ্ঠে কালো দাগ দেখা যায়। এটা নাইট্রোজেন জাতীয় বর্জ্য পদার্থ জমা হওয়ার জন্য হয়।

(গ) সাদা দাগ: লেজের পেশী অস্বচ্ছ সাদাটে হয়ে যায়। পরিবেশের প্রতিকূলতার জন্য এই রোগ হয়।

প্রতিকার: পুকুরের পরিবেশের উন্নতি, চিংড়ির সংখ্যা কমানো, উপযুক্ত ও উন্নতমানের খাদ্য পরিবেশন করে এসব সমস্যা কমানো যায়।

বাগদা চিংড়ি 

নোনাজলে চিংড়ি (বাগদা) চাষ

বাগদা চিংড়ি হল নোনাজলের অন্যতম চিংড়ি। উপকূলবর্তী সমুদ্রে, নদীর মোহনা ও নোনাজলের জলাভূমিতে বাগদা চিংড়ি পাওয়া যায়। পরিবেশ দূষণ, ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের অবক্ষয় ও অতিরিক্ত বা অনিয়ন্ত্রিত খরার জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশে এদের প্রাপ্তি ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশের ও বিদেশের বাজারে চাহিদা অনেক বেশি বাড়ছে। আবার দ্রুত বৃদ্ধি, আকারে বড়, বাঁচার হার বেশি ও কৃত্রিম খাদ্যগ্রহণে অভ্যস্ত হয় বলে বাগদা চিংড়ি চাষের জনপ্রিয়তা বেশি। নোনা জলের চাষযোগ্য অনেক প্রজাতির চিংড়ি আমাদের দেশে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি প্রজাতি হল-

  • (ক) বাগদা চিংড়ি (পিনিয়াস মনোডন)
  • (খ) চাপড়া চিংড়ি (পিনিয়াস ইন্ডিকাস)
  • (গ) হেঁড়ে চিংড়ি (পিনিয়াস সেমিসালকেটাস)
  • (ঘ) পিনিয়াস মারগুয়েনসিস
  • (ঙ) মেটা পিনিয়াস মনোসেরস
  • (চ) মেটা পিনিয়াস অ্যাফিনিস
  • (ছ) মেটাপিনিয়াস ব্রেভিকরনিস
  • (জ) মেটাপিনিয়াস ডবসনি


খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস

বাগদা জাতীয় সমস্ত চিংড়ির খাদ্যাভাসে তারতম্য দেখতে পাওয়া যায়। আবার এদের বিভিন্ন লার্ভা দশায়ও খাদ্যাভাসে তারতম্য দেখা যায়। যেমন-নপ্লিয়াস দশায় কুসুম থলির সঞ্চিত খাদ্য খায় বলে বাইরের কোন খাদ্য খায় না, পরবর্তী জুইয়া দশায় ডায়াটম জাতীয় উদ্ভিদ কণা খায় এবং তৃতীয় দশা বা মাইসিস দশায় প্রাণীকণা খায়। লার্ভা উত্তর দশার প্রথম ৫ দিন মাইসিস দশার অনুরূপ খাদ্য খায় ও তারপর ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ চিংড়ির অনুরূপ খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হয়। পূর্ণাঙ্গ বাগদা চিংড়ি প্রায় ৮৫ শতাংশ কবোচী প্রাণী (ছোট কাঁকড়া এবং কুঁচো চিংড়ি) ও খোলকী প্রাণী (শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি) এবং ১৫ শতাংশ পলিকীট কৃমি, পচা আবর্জনা, বালি ও কাদামাটি ইত্যাদি খাদ্য ও কাদামাটি ইত্যাদি খাদ্য হিসাবে খায়।

স্ত্রী ও পুরুষ চিংড়ি

বহিরাকৃতি দেখে স্ত্রী ও পুরুষ চিংড়ি আলাদা করা যায়। সাধারণতঃ প্রায় ৩ মাস বয়সে স্ত্রী চিংড়ির ৫ম ভ্রমণ পদদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে বক্ষদেশে 'থেলিকাম' এবং পুরুষ চিংড়ির প্রথম সন্তরণ পদদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে 'পেটাসমা' নামক ক্ষুদ্র উপাঙ্গ দেখা যায়। তবে একই বয়সের স্ত্রী চিংড়ি পুরুষ চিংড়ির থেকে আকারে বড় হয়।

চারা সংগ্রহ

বাগদা চিংড়ি সমুদ্রের মধ্যে উপকূল থেকে দূরে ডিম পাড়ে ও পরে নদীর মোহনা অঞ্চলে চলে আসে। পশ্চিমবঙ্গের ডায়মন্ডহারবার, নামখানা, উলুবেড়িয়া, নূরপুর, সাগরদ্বীপ ফ্রেজারগঞ্জ, বকখালি, কুলপি, কাকদ্বীপে বাগদা চিংড়ির চারা পাওয়া যায়।

শনাক্তকরণ

বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ির চারা বহিরাকৃতি ও রঙ দেখে শনাক্তকরণ করা হয়। চারার অঙ্কদেশে লালাভ ও নীলাভ সবুজ ডোরাকাটা দাগ দেখে খুব সহজেই বাগদার চারা শনাক্ত করা যায়।

একটি পাত্রে চিংড়ির চারা নিয়ে তার মধ্যে কিছু পাতা বা খড়কুটো দিলে বাগদার চারাগুলো ওই পাতা বা খড়কুটোর গায়ে লেগে যায়। পাত্র থেকে পাতা বা খড়কুটো তুলে বাগদার চারা আলাদা করা যায়।

নাশারি পুকুরে চাষ

প্রাকৃতিক উৎস থেকে বিস্তিজালে সংগৃহীত বাগদা চারাগুলো সরাসরি মজুত পুকুরে না ছেড়ে নাশারি পুকুরে ১ মাসের জন্য চাষ করতে হয়। 

নার্শারি পুকুরের বা আঁতুড় পুকুরের আয়তন ৫-১৫ কাঠা ও গভীরতা। ২.৫-৩.০ ফুট হয়। পুকুরে জলের প্রবেশদ্বার ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হয়। পুকুরটির বেশিরভাগ জল বের করে অল্প জলে বিঘা প্রতি জলের গভীরতা অনুযায়ী ২৫০-৩০০ কিলোগ্রাম মহুয়া খোল প্রয়োগ করে শামুক, কাঁকড়া ও অবাঞ্ছিত মাছ মেরে ফেলতে হয়। তারপর রোদে ভাল করে শুকিয়ে বিঘা প্রতি ২০-২৫ কিলোগ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হয়। এরপর বিঘা প্রতি গোবর ১০০-১৫০ কিলোগ্রাম বা মুরগির মল ৫০-৭৫ কিলোগ্রাম প্রয়োগ করতে হয়। এর ২ সপ্তাহ পর পুকুরে জল প্রবেশ করিয়ে জলের গভীরতা ১-১.৫ ফুট করতে হয়। তারপর বিঘা প্রতি ৫-৬ কিলোগ্রাম করে ইউরিয়া ও সিঙ্গল সুপার ফসফেট প্রয়োগ করে পুকুরের তিন ভাগের এক ভাগ অংশে তাল বা খেজুর পাতা দিতে হয়। দু' সপ্তাহ পর পুকুরে পুনরায় জল প্রবেশ করিয়ে জলের গভীরতা ২.৫-৩.০ ফুট করতে হয়। বিঘা প্রতি ৪০,০০০-৬০,০০০ সংখ্যক বাগদার চারা মজুত করতে হয়। এক মাসে ২-২.৫ ইঞ্চি মাপের হয় এবং বাঁচার হার ৩০-৭০ শতাংশ।

মজুত পুকুরে চাষ

বর্তমানে নোনাজলে বাগদা চিংড়ি চাষ খুব লাভজনক হওয়ায় দেশে ও বিদেশে বেশিরভাগ উপকূলবর্তী অঞ্চলে চিংড়ি খামার তৈরি হয়েছে এমনকি বহুজাতিক সংস্থাও এই বাণিজ্যে সামিল হয়েছে। উপকূলবর্তী অঞ্চলে চিংড়ি চাষের জন্য পরিবেশ দূষণ হয় তাই দীর্ঘদিন গবেষণা করে এই দূষণ মাত্রা কমিয়ে লাভজনক চাষ পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে। এই পদ্ধতিতে ১২০-১৫০ দিনের সময়কালের জন্য চাষ করা হয়।

মজুত পুকুরের আয়তন ১ বিঘা-৭.৫ বিঘা হয়। নার্শারি পুকুরের মত মজুত পুকুরে জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করে পুকুর মাছ চাষের উপযোগী করা হয়। নাশারি পুকুর থেকে চিংড়ি চারা তুলে বিঘা প্রতি ২৫০০-৩৫০০ সংখ্যক মজুত করতে হয়। প্রতিদিন পুরপূরক খাবার হিসাবে চালের কুঁড়ো, বাদাম খোল ও মাছের গুঁড়ো সমহারে মিশিয়ে মোট চিংড়ি চারার ওজনের ৩-৫ শতাংশ হারে প্রয়োগ করতে হয়। পুষ্টিসমৃদ্ধ কৃত্রিম খাদ্য প্রয়োগ করলে দিনে ২-৩ বারে ভাগ করে মোট দেহ ওজনের ২-৫ শতাংশ হারে প্রয়োগ করতে হয়। এই খাবারে দাম খুব বেশি তাই অপচয় রুখতে প্রতিদিন চিংড়ির খাদ্য চাহিদা হিসাব করে খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি কিলোগ্রাম চিংড়ি উৎপাদন করার জন্য ৩-৬ কিলোগ্রাম পরিপূরক খাদ্য এবং ১.৫-২.৫ কিলোগ্রাম কৃত্রিম খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়।

বাগদা চিংড়ির রোগ ও প্রতিকার

বাগদা চিংড়ি প্রধানত পরিবেশের প্রতিকূলতার জন্য রোগে আক্রান্ত হয়। পুকুরের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে রোগের প্রকোপ কমানো যায়।

(ক) পাতলা খোলস রোগ: প্রতিকূল পরিবেশে এই রোগ হয়। জল পরিবর্তন করে, চুন প্রয়োগ করে ও পুষ্টিকর খাদ্য প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

(খ) উপাঙ্গের পচন: প্রাথমিক অবস্থায় উপাঙ্গসমূহের ডগায় বাদামী দাগ ও পরে কালো হয়। ক্লোরামফেনিকল ২-১০ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার জলে প্রয়োগ করলে সুফল পাওয়া যায়।

(গ) সাদা ছোপ রোগ: এটি' একটি সংক্রামক রোগ। সাদা ছোপ ছোপ দাগ সারা শরীরে দেখা দেয়। এই রোগে চিংড়ির ব্যাপক মড়ক দেখা দেয়। সাধারণতঃ প্রজননে অংশগ্রহণকারী (ব্রুডার) চিংড়ি থেকে বা জলীয় পরিবেশ থেকে সংক্রামিত হয়। এই রোগের এখনও কোন প্রতিকারের উপায় নেই।

গলদা চিংড়ির প্রজনন

আমাদের দেশে গলদা চিংড়ির প্রজনন ও হ্যাচারিতে চারা উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ততটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। কারণ গলদা চিংড়ি প্রজনন কার্পজাতীয় মাছের মত সহজ নয়। তবে গলদা চিংড়ির বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষের প্রসার ঘটলে গলদা চিংড়ির প্রজনন জনপ্রিয়তা অর্জন করবে।

হ্যাচারি নির্মাণ

স্থান নির্বাচন: গলদা চিংড়ির প্রজননের জন্য নোনা ও স্বাদু দু'রকমের জলের প্রয়োজন হয়। তাই সমুদ্রোপকূলে হ্যাচারি নির্মাণ করা সুবিধাজনক। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুতের সুবিধাও থাকা প্রয়োজন।

প্রজনন ও হ্যাচারি পরিচালনা: হ্যাচারির জন্য নোনা ও স্বাদুজলের ব্যবস্থা করে লার্ভা প্রতিপালন জলাধারে প্রয়োজনীয় ঈষৎ নোনা (১২ পি.পি.টি.) জলের ব্যবস্থা করতে হয়। এরপর প্রজননক্ষম চিংড়ি মাছ সংগ্রহ করতে হয়। সংগৃহীত চিংড়ি মাছ স্বাদুজলের জলাধারে ছেড়ে বায়ু সঞ্চালন করতে হয় ও সেই জলে লিটার প্রতি ০.২-০.৫ মিলিগ্রাম কপার সালফেট বা ১৫-২০ মিলিগ্রাম ফর্মালিন মেশানো হয়। চিংড়ি মাছের অঙ্কীয়দেশে বাদামী বা কালচে বাদামী রঙের ডিম দেখে প্রজননক্ষম চিংড়ি নির্বাচন করতে হয়।

লার্ভা প্রতিপালন ট্যাঙ্কে (আয়তন ১০০০ লিটার) ৩-৪টি ডিমসহ গলদা চিংড়ি জীবাণুমুক্ত করে প্লাস্টিকের খাঁচায় করে মিশ্র জলে (১২ পি.পি.টি.) রাখা হয়। ডিম ফুটে লার্ভা সরাসরি জলে চলে আসার পর বড় চিংড়িগুলোকে সরিয়ে নিতে হয়। লার্ভাগুলোকে ৩-৪ দিন কোন খাবার দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে প্রতিনিয়ত বায়ু সঞ্চালনের ব্যবস্থা রাখতে হয়।

গলদা চিংড়ির লার্ভা প্রতিপালনের জন্য ক্ষুদ্র প্রাণীকণা (আর্টিমিয়ার লার্ভা) খুব প্রয়োজন। আর্টিমিয়ার সিস্ট থেকে লার্ভা (নপ্লিয়াস) দশা-১ ও লার্ভা দশা-২ চিংড়ির লার্ভার খাদ্য হিসাবে প্রথম ১০ দিন দিনে দু'বার করে প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি লিটার জলে ১০০০-৫০০০ সংখ্যক আর্টিমিয়ার লার্ভা হিসাবে প্রয়োগ করতে হয়।

গলদা চিংড়ির ১১টি লার্ভা দশা আছে। লার্ভা দশা থেকে লার্ভা-উত্তর দশায় রূপান্তর খাদ্য, তাপমাত্রা ও পরিবেশের উপর নির্ভর করে। উপযুক্ত পরিবেশে ৩৫-৪৫ দিনে লার্ভা দশা সম্পন্ন হয়। জলের লবণতা ধীরে ধীরে কমিয়ে লার্ভাত্তোর দশা স্বাদুজলে শেষ করতে হয়। তারপর অন্য ট্যাঙ্কে স্থানান্তরিত করতে হয়।

Shaharuk Islam

Hi I am Shaharuk Islam. I enjoyed in writing articles and spread knowledge cross over the internet.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

Ad

Magspot Blogger Template

Ad

amazon.in
amazon.in

نموذج الاتصال