মানবদেহের রক্ত: জীবনধারার অপরিহার্য মাধ্যম ও এর কার্যাবলি

BLOOD
BLOOD

 মানবদেহের রক্ত: জীবনধারার অপরিহার্য মাধ্যম


রক্তকে প্রায়ই "জীবনের নদী" বলা হয়, কারণ এটি দেহের প্রতিটি কোষে অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছে দেয়, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই জটিল তরলটির মধ্যে রয়েছে কোষ, প্লাজমা, প্রোটিন, ও পুষ্টি উপাদানের সমন্বয়, যা শরীরের সুস্থতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আসুন জেনে নেই রক্ত কী, এর উপাদান, এবং এটি কীভাবে মানবদেহকে জীবিত রাখে।


 রক্ত কী?


রক্ত হল একটি বিশেষায়িত তরল সংযোগকারী কলা, যা প্লাজমা এবং রক্তকোষের সমন্বয়ে গঠিত। এটি একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, যা শরীরের প্রতিটি কোষে প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করে। রক্ত সামান্য ক্ষারীয় প্রকৃতির এবং এর pH প্রায় ৭.৪। এটি সাধারণত লাল, কারণ এতে হিমোগ্লোবিন নামক প্রোটিন থাকে, যা অক্সিজেন বহন করে।


রক্তের প্রধান বৈশিষ্ট্য


  • - **প্রকৃতি:** রক্ত একটি তরল সংযোগকারী কলা।
  • - **উপাদান:** এটি প্রায় ৫৫% প্লাজমা এবং ৪৫% কোষ নিয়ে গঠিত।
  • - **লবণাক্ততা:** রক্তের মধ্যে সামান্য লবণাক্ততা রয়েছে।
  • - **তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ:** এটি শরীরে তাপ পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
  • - **প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা:** সাদা রক্তকণিকা (লিউকোসাইট) সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে।


রক্তের উপাদান


রক্ত মূলত প্লাজমা, লাল রক্তকণিকা, সাদা রক্তকণিকা এবং প্লেটলেট নিয়ে গঠিত। প্রতিটি উপাদানের নিজস্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।


1. **প্লাজমা**  
   প্লাজমা হল রক্তের প্রায় ৫৫% অংশ, যা হলুদাভ একটি তরল, যা কোষ ও দ্রবীভূত উপাদানগুলির বাহক হিসেবে কাজ করে। প্লাজমার প্রায় ৯১-৯২% জল, এবং বাকি অংশটি প্রোটিন, পুষ্টি, হরমোন ও বর্জ্য পদার্থ নিয়ে গঠিত।
  

 - **অজৈব উপাদান:** সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ও লোহা সামান্য পরিমাণে উপস্থিত থাকে এবং এটি বিভিন্ন বিপাকীয় কার্যক্রমে সাহায্য করে।
  

 - **জৈব যৌগ:** প্লাজমা প্রোটিন (অ্যালবুমিন, গ্লোবুলিন, ফাইব্রিনোজেন), গ্লুকোজ এবং অন্যান্য পুষ্টি কোষীয় কার্যক্রমে সমর্থন প্রদান করে।
  

 - **গ্যাসীয় পদার্থ:** অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, এবং নাইট্রোজেন উপস্থিত থাকে, যা শ্বাসকার্যের জন্য প্রয়োজনীয়।
  

 **প্লাজমার কার্যাবলি:**

  •    - অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, পুষ্টি, হরমোন ও বর্জ্য পদার্থ পরিবহন করে।
  •    - রক্ত জমাট বাঁধার জন্য ফাইব্রিনোজেন সরবরাহ করে।
  •    - রক্তের pH ও আয়তনের ভারসাম্য বজায় রাখে।

2. **লাল রক্তকণিকা (ইরিথ্রোসাইট)**  

   লাল রক্তকণিকা বা ইরিথ্রোসাইট হল দ্বিবাঁকা চাকতি আকৃতির কোষ, যা দেহের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড বহন করে। লাল রক্তকণিকায় নিউক্লিয়াস নেই, যা হিমোগ্লোবিন ধারণে সহায়তা করে।
  

 - **উৎপাদন:** লাল অস্থিমজ্জায় উৎপন্ন হয়।
  

 - **আয়ুষ্কাল:** প্রায় ১২০ দিন।
  

 - **কার্যাবলি:** অক্সিজেনকে ফুসফুস থেকে দেহকোষে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডকে কোষ থেকে ফুসফুসে পরিবহন করে।

3. **সাদা রক্তকণিকা (লিউকোসাইট)**  
   

সাদা রক্তকণিকা হল নিউক্লিয়াসযুক্ত কোষ, যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে। এগুলি বিভিন্ন ধরনের হয় এবং প্রতিটি উপাদান বিশেষায়িত প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করে।
   

- **গ্রানুলোসাইট:** নিউট্রোফিল, ইওসিনোফিল ও বেসোফিল থাকে, যা ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী ও অ্যালার্জির বিরুদ্ধে প্রতিরোধে সহায়তা করে।
  

 - **অ্যাগ্রানুলোসাইট:** লিম্ফোসাইট (অ্যান্টিবডি উৎপন্ন করে) ও মনোসাইট (ফ্যাগোসাইটোসিসে অংশ নেয়) প্রধান প্রতিরক্ষা ভূমিকা পালন করে।


   **সাদা রক্তকণিকার কার্যাবলি:**
   
  •   - সংক্রমণের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে।
  •   - ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া ও মৃত কোষ গ্রাস করে।
  •   - রক্ত জমাট বাঁধার জন্য থ্রম্বোপ্লাস্টিন নিঃসরণ করে, যা রক্তক্ষরণ প্রতিরোধে সহায়তা করে।

4. **প্লেটলেট (থ্রম্বোসাইট)**  
  

 প্লেটলেট হলো ক্ষুদ্র কোষীয় খণ্ড, যা রক্ত জমাট বাঁধায় সহায়তা করে। এটি ক্ষতিগ্রস্ত রক্তনালী পুনরুদ্ধার ও রক্তক্ষরণ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে।

  •    - **উৎপাদন:** প্লেটলেট বড় অস্থিমজ্জা কোষ থেকে উৎপন্ন হয়।
  •    - **আয়ুষ্কাল:** প্রায় ৩ দিন।
  •    - **কার্যাবলি:** থ্রম্বোপ্লাস্টিন মুক্ত করে রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে, যা রক্তক্ষরণ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ।


রক্তে শ্বাসযানক রঞ্জক


রক্তে হিমোগ্লোবিন এবং কিছু অমেরুদণ্ডীদের ক্ষেত্রে হিমোসায়ানিনের মতো শ্বাসযানক রঞ্জক থাকে। হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে অক্সিহিমোগ্লোবিন তৈরি করে, যা কোষে অক্সিজেন পরিবহন করে। এটি কার্বন ডাই-অক্সাইডের সাথেও যুক্ত হয়, যা দেহ থেকে দূরীকরণে সহায়তা করে।


  • - **হিমোগ্লোবিন:** অধিকাংশ মেরুদণ্ডীতে পাওয়া যায়, যা রক্তের লাল রঙের জন্য দায়ী।
  • - **হিমোসায়ানিন:** কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণীর রক্তে দেখা যায়, যা কপারভিত্তিক রঞ্জক হওয়ায় রক্তকে নীল রঙ প্রদান করে।

রক্তের রোগ ও স্বাস্থ্য


রক্তের একটি সাধারণ রোগ হলো অ্যানিমিয়া, যেখানে লোহিত রক্তকণিকা বা হিমোগ্লোবিনের অভাব দেখা দেয়, ফলে ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভূত হয়। এছাড়া রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা ও সংক্রমণজনিত রোগও স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

রক্তের উপাদান ও কার্যাবলি সম্পর্কে জানলে বোঝা যায় যে এটি শুধুমাত্র অক্সিজেন পরিবহনের মাধ্যম নয়; এটি একটি অত্যন্ত জটিল সিস্টেম, যা দেহের সুরক্ষা, পুষ্টি এবং সমন্বয় বজায় রাখতে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।

Shaharuk Islam

Hi I am Shaharuk Islam. I enjoyed in writing articles and spread knowledge cross over the internet.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

Ad

Magspot Blogger Template

Ad

amazon.in
amazon.in

نموذج الاتصال