প্রণোদিত প্রজনন পদ্ধতি (Method of induced breeding)
বর্ষাকাল কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন ঋ
তু (breeding season)। এই সময় পরিণত স্ত্রীমাছের ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণুর সঞ্চার ঘটে এবং পরিণত পুরুষ মাছের শুক্রাণুর উৎপাদন হয়। লক্ষ করা গেছে পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী ও পুরুষ মাছ তাদের প্রজনন ক্ষেত্রে (breeding ground) জড়াজড়ি করে খেলা করতে থাকে, একে বলে স্পোর্ট (sport)। স্পোর্ট শেষে স্ত্রী মাছ জলে ডিম ছাড়ে এবং পুরুষ মাছ শুক্রাণু নিষ্ক্রমণ করে। বহিঃনিষেকের (external fertilization) মাধ্যমে জলে শুক্রাণু দ্বারা ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়। নিষিক্ত ডিম (fertilized egg) পরিস্ফুটিত হয়ে সদ্য নির্গত যে লার্ভা দশার উদ্ভব ঘটে তাকে বলে হ্যাচলিং (hatchling)। এরা প্রাথমিক পর্যায়ে দেহস্থ কুসুম থলি (Yolk sac) থেকে সঞ্চিত খাদ্যবস্তু শোষণ করে বেড়ে ওঠে। এরপর তারা সকলেই প্রাণীকণা (জুপ্ল্যাঙ্কটন) খেয়ে বর্ধিত হয়। অতঃপর নিজ নিজ খাদ্যাভাস অনুযায়ী কয়েকপ্রকার মাছ শুধুমাত্র উদ্ভিদকণা (ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন) খেতে থাকে, অপরদিকে কিছু মাছ প্রাণীকণা খায়। উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে ডিমপোনা ( spawn), ধানিপোনা (fry), চারাপোনা (fingerling) এবং পূর্ণাঙ্গ মাছে (adult fish)-এ পরিণত হয়।
সর্বপ্রথম ড. হীরালাল চৌধুরী 1955 সালে ভারতবর্ষে এই কাজে সাফল্য পান। তিনি কাতলা মাছের পিটুইটারি গ্রন্থির নির্যাস (extract of pituitary gland) এক ধরনের মাইনর কার্পের (Esomus douricus) দেহ পেশিতে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করে বদ্ধ জলাশয়ে তাদের স্পনিং করাতে সক্ষম হন। 1957 সালে তিনি এবং আলিকুনি (H. Chaudhury and K. H. Alikuni) কার্পের পিটুইটারি গ্রন্থির নির্যাস ভারতীয় মেজর কার্পের ওপর প্রয়োগ করে প্রণোদিত প্রজননে সাফল্য পান। এরপর ভারতের কেন্দ্রীয় অন্তর্দেশীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের (Central Inland Fisheries Research Centre) গবেষকরা বিদেশাগত কার্পের প্রণোদিত প্রজনন 1963 সালে সফলভাবে সম্পন্ন করেন। প্রণোদিত প্রজনন কী? (What is Induced breeding?) :
যে পদ্ধতিতে একই প্রজাতির বা সমজাতীয় মাছের প্রজাতির পিটুইটারি গ্রন্থির নির্যাস (হরমোন গোলা দ্রবণ) অথবা সাদৃশ্যমূলক রাসায়নিক পদার্থ নির্দিষ্ট পরিমাণে,স্ত্রী ও পুরুষের দেহে প্রবেশের দ্বারা তাদের প্রজননে উদ্দীপিত করা হয়। ফলে স্ত্রী মাছ ডিম্বাণু ও পুরুষ মাছ শুক্রাণু ত্যাগ করে নিষেক সম্পন্ন হয়, তাকে প্রণোদিত প্রজনন (Induced breeding) বলে। পিটুইটারি গ্রন্থির অপর নাম হাইপোফাইসিস (Hypophysis) হওয়ায় এই পদ্ধতির অপর নাম হাইপোফাইজেশন (Hypophysation)।
মাছের পিটুইটারি গ্রন্থির অবস্থান ( Location of pituitary gland in fish): অস্থিযুক্ত মাছের মস্তিষ্কের তৃতীয় প্রকোষ্ঠের নীচের অংশে অর্থাৎ ডায়েনসেফালনের অঙ্কীয় তলে সেলাটারসিকা (Sella turcica) নামক অস্থি-কোটরে পিটুইটারি গ্রন্থি অবস্থিত। এটি ডুরা ম্যাটার (dura mater) নামক মস্তিষ্কের বহিঃআবরক পর্দা (outer meninges) দ্বারা আবৃত থকে। আকৃতিতে ছোটো মটর দানার ন্যায় এবং লালচে সাদা বর্ণের হয়। ইনফান্ডিবুলাম নামক একটি ছোটো উপবৃদ্ধি দ্বারা
এটি মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত থাকে। মাছের পিটুইটারি গ্রন্থি ক্ষরিত প্রজননে সাহায্যকারী হরমোন (Hormones secreted from pituitary gland related to fish breeding):
পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নানাবিধ হরমোন ক্ষরিত হয়। এগুলির মধ্যে প্রজননে সাহায্যকারী হরমোন হিসাবে চিহ্নিত ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH) এবং লিউটিনাইজিং হরমোন (LH)। এদেরকে একত্রে গোনাডোট্রপিক হরমোন বা GTH বলে। GTH ডিম্বাশয় ও শুক্রাশয়কে উদ্বুদ্ধ করে, পরিণত মাছকে প্রজননে প্রণোদিত করে এবং স্পনিং-এ ইন্ধন জোগায়।
সাফল্যের সঙ্গে কার্পের প্রজনন পদ্ধতি সম্পন্ন করার জন্য নিম্নবর্ণিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
সবিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হল – কার্প জাতীয় মাছ স্রোতবিহীন বা আবদ্ধ জলাশয়ে (stagnant water) বেড়ে উঠতে পারে কিন্তু কখনও জনন কার্য সম্পন্ন করে না অর্থাৎ ডিম পাড়ে না। প্রবহমান জলাশয় যেমন নদ, নদী বা এদের আশেপাশের প্লাবিত জলাশয়ে কার্পেরা তাদের জনন কোশ (ডিম্বাণু ও শুক্রাণু) ত্যাগ করে, যাকে স্পনিং (spawning) বলে। স্পনিং ঘটনা নির্ভর করে কতিপয় বাহ্যিক ও শর্তের উপর। বাহ্যিক শর্ত যেমন—বৃষ্টিপাত, কম তাপমাত্রা ও বেশি আর্দ্রতা, বেশি দ্রবীভূত অক্সিজেন যুক্ত জলস্রোত, খাদ্যের প্রাচুর্য প্রভৃতি। অভ্যন্তরীণ শর্তের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হল পিটুইটারি গ্রন্থি নিঃসৃত গোনাডোট্রপিক হরমোন (Gonadotropic hormone বা GTH)। এই বিষয়টি জানার পর পৃথিবীরবিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে গবেষণা চলতে থাকে পিটুইটারি গ্রন্থির ক্ষরণ মাছের দেহে ইনজেক্ট করে মাছকে প্রজননে উদ্দীপ্ত করা যায় কিনা।