![]() |
মাছ চাষের পরিবেশগত দিক |
বিজ্ঞান প্রযুক্তি ব্যবহার করে জলাশয়ে চুন, সার ও বীজ মাছ ছেড়ে উপযুক্ত পরিচর্যা দ্বারা পালন পোষণে মাছের ফলন বৃদ্ধির ব্যবস্থাকে মাছ চাষ বলা হয়। মাছ চাষের জন্য দরকার দূষণ মুক্ত এক বা একাধিক জলাধার। বিভিন্ন উপকরণ হিসাবে চূন, জৈব ও অজৈব সার, মাছের বীজ, পরিপূরক খাবার, জাল, হাঁড়ি ইত্যাদি।
• মাছ চাষের পুকুর ( Fish Pond )
মাছ জলচর শীতল রক্ত বিশিষ্ট প্রাণী, আজীবন জলে বাস করলেও মাছ চাষের উৎকর্ষতা নির্ভর করে জলতলের মাটি বা পাকের গুণগতমানের উপর। কৃষি ফসল যেমন উর্বর মাটিতে ভাল হয় মাছ ও তেমনি উর্বর মাটি পরোক্ষে জলের উপর নির্ভরশীল। দোঁয়াশ (Alluvial) ও পলিযুক্ত কাদা মাটি (Silt) মাছ চাষের পক্ষে ভাল। জলাশয় গোলাকার, বর্গাকার আয়তকার যেমনই হোক না কেন সবই চাষযোগ্য, তবে আয়তাকার জলাশয়ে মাছ চাষ যথেষ্ট সুবিধাজনক। জলাশয় পাঁকহীন না করে ৮-১০ ইঞ্চি পাঁক অবশ্যই রাখা দরকার আবার বেশি পাঁক (১ ফুটের বেশি) ক্ষতিকর। জলাশয় পাড় পূর্ব-দক্ষিণে ফাকা থাকা দরকার। পাড়ে জল প্রবেশের ও নিকাশের ব্যবস্থা (Inlet & Outlet) রাখতে হবে। পাড়ে সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর ইত্যাদির গর্ত বুজিয়ে দিতে হবে। চারিদিকের আগাছা ও জলজ ঝাঁঝি পানা সরিয়ে ফেলতে হবে। জলাশয়ে শীতের শেষ থেকে প্রাক বর্ষা পর্যন্ত গড়ে ৪ ফুট জল রাখতে হবে। পাড়ের কিনারায় কলাবাগান, বাঁশঝাঢ়, তেঁতুল ও শিরিষ গাছ থাকলে ও সদ্য কাটা নতুন জলাশয়ে মাছের ফলন ভাল হয় বালিযুক্ত (Sandy) বা এঁটেল (Sticky) মাটির জলতল পরিচর্যা গুণে ভাল ফলন দিতে পারে।
![]() |
মাছ চাষের পুকুর |
জলধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন দোঁয়াশ বা পলিযুক্ত উর্বর জলতল, পুরানো বা পচা পাকমুক্ত হবে। ৮-১০ ইঞ্চি পাঁক অবশ্যই দরকার। জলের তলার মাটির ধর্ম হবে এইরকম
পিএইছ(pH)--------5.5 থেকে 7.5
জৈব অঙ্গার (Organic carbon) ----0.5 থেকে 2.5%
(১০০ গ্রাম মাটিতে)
•যবক্ষার জান (Nitrogen) ---------50 মিলিগ্রাম
(১০০ গ্রাম মাটিতে)
ফসফেট (P2O5) --------6 মিলিগ্রামের বেশি
অঙ্গার : যবক্ষার জ্ঞান (CN) -----------10 মিলিগ্রামের বেশি
তাপমাত্রা (Temperature)----------20 থেকে 30 ডিগ্রি সেলসিয়াস
পাকের রঙ----------- কালচে ধূসর
এছাড়া নানা রকমের হিতকর ব্যাকটেরিয়া বা জীবাণু (Micro-organisms) পাঁকের মধ্যে থাকা জরুরি, কারণ তারাই জলাশয়ে সঞ্চিত হওয়া জৈব বর্জ্য পদার্থের (organic waste) পচন ত্বরান্বিত করে জলে প্রয়োজনীয় অণুখাদ্যের (Micro nutrients) যোগান দেয়।
জল মাছের বাসস্থান, তার জীবনচক্রের পরিবেশ ও বেঁচে থাকার মাধ্যম। জলই তার প্রকৃত জীবন। সুতরাং মাছের জল সবরকম দূষণ মুক্তথাকা বাঞ্ছনীয়। মাছ চাষের জল নদীর, বৃষ্টির, ঝরণার হলে খুব ভাল হয়। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত অল্প খর (Hard) জল চাষের পক্ষে ভাল। খুব গরম বা খুব ঠান্ডা হলে ফলন ভাল হবে না।
• মাছ চাষের উপকরণ (Ingredients)
(ক) চুন (Lime) : একটি প্রধান উপকরণ, মাছ চাষে ফলন বৃদ্ধি, জল দূষণ রোধ ও মাছকে নীরোগ রাখতে চুনের গুণ বর্ণনাতীত।
"নুন বিনা তরকারি বিস্বাদ যেমন, চুন বিনা মাছ চাষে নিরাশ ফলন।"
চুন তিন রকমের পাওয়া যায়
- (১) পোড়াচুন বা কুইক লাইম (CaO)
- (২) কলিচুন বা স্ল্যাড লাইম (CaOH) ও
- (৩) চুনা পাথর বা লাইমস্টোন (CaCO3)-এর মধ্যে পোড়াচুন সব থেকে বেশি কার্যকারী।
জলাশয়ের প্রাথমিক উৎপাদন ক্ষমতা (Primary productivity) ও প্রাথমিক জীব কণার উৎপাদন সম্পূর্ণ নির্ভর করে তলের পাঁকে থাকা পৌষ্টিক উপাদানের উপর। চুন প্রয়োগে পাঁক ক্ষারকীয় (Alkaline) হয় এবং প্রাথমিক উৎপাদন সহজ হয়ে মাছ চাষের পরিবেশ অনুকূল হয়।
![]() |
চুন প্রয়োগ |
চুন জল পরিষ্কার করার ফলে আলো বাতাস জলাশয়ের গভীরে যেতে পারে ও সালোকসংশ্লেষ ভাল হয় এবং জল ও চুনের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় দ্রবীভূত অম্লজান বৃদ্ধি পায়। চুনের ক্যালশিয়াম মাছের হাড় শক্ত করে, জলে মাছের রোগ জীবাণু নষ্ট করে। চুন জলে প্রদত্ত অজৈব যৌগ উপাদানের বিশ্লেষ ঘটায়। জলাশয়ে চুনের পরিমাণ নির্ভর করে তলদেশের আয়তন ও পিএইচ মাত্রার উপর। বিঘা প্রতি ৩ বস্তা চুন প্রয়োগ করুন।
সাধারণত জলাশয়ের পিএইচ ৫ এর নীচে নামে না পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে।
বেশি মাত্রায় প্রয়োগ হলে প্রাকৃতিক জীবকণা ও শিশুমাছের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রয়োজন অনুযায়ী চুন এনে আগেরদিন রাতে একটি পাত্রে (অ্যালুমিনিয়াম পাত্রে নয়) ভিজিয়ে রেখে পরদিন জলে ভাল করে গুলে সমস্ত পুকুরে ছড়াতে হবে।
(খ) সার (Fertilizer) : জল ও মাটি দূষণের ফলে কৃষি ও মাছ চাষে বিনা সারে আশানুরূপ ফলন পাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। কৃষিতে ব্যবহার্য্য সকল জৈব ও অজৈব সারই মাছ চাষেব্যবহার করা হয়। সকল সারই Nitrogen, Phosphate, Patash (N.P.K) সমৃদ্ধ।
সব রকমের তেল বীজের (Oil seeds), খোল (Cakes), গবাদি পশুর মল ( Cattle হাঁস মুরগির মল (Litters), তরি-তরকারির বর্জ্য (Vegetble wastes), জলজ উদ্ভিদ, পাতা, ঘাস, খড় পচানো মিশ্রসার, কেঁচো সার (Vermicompost) জৈব সারের অন্তর্গত। এছাড়া কয়েকটি উদ্ভিদের যেমন, কাল কাসুন্দা ও চাকুন্দা (Cassia sp.), ধইঞ্চা (Sesbania sp..) সুবাবুল (Leucaena sp), পুঁই (Basella sp.) ও বাঁধাকপির (Cabbage), কাণ্ড পাতা সরাসরি জলে পচালেও ভাল সার হয়।
![]() |
জৈবসার |
জলাশয়ে জৈবসার ব্যবহার করার নিয়ম (একক শতকে ৩ ফুট গভীরতায়)
গবাদি পশুর মল প্রথমে ২০ কেজি, প্রতি মাসে ৪ কেজি বা হাঁসমুরগির মল প্রথমে ৩ কেজি, প্রতি মাসে ৭৫০ গ্রাম, বা কেঁচো/মিশ্রসার প্রথমে ৫ কেজি, প্রতিমাসে ৫০০ গ্রাম, বা সরষে খোল ৫ কেজি, প্রতিমাসে ৫০০ গ্রাম, বা মহুয়া খোল
(ক) দশ কেজি একবারে (আমাছা মারতে)
'প্রথমে বিষ মারে মাছ ।পচলে জলে বাড়ায় মাছ'
(খ) পচিয়ে সার হিসাবে প্রথম প্রয়োগের পর মাসে ৫০০ গ্রাম জলে ভিজিয়ে রেখে।বা গোবর গ্যাস স্নারি প্রথমে ১৫ কেজি প্রতিমাসে ৪ কেজি
• অজৈবসার (Inorganic Fertilizers )
সিংগল সুপার ফসফেট জল ও মাটির পরীক্ষা সাপেক্ষে অজৈব বা রাসায়নিক সার ব্যবহার করা যাবে। অজৈব সারের মধ্যে ইউরিয়া CO (NH2 ) 2 – (নাইট্রোজেনের মাত্র ৪৬ শতাংশ), অ্যামোনিয়াম সালফেট (NH4)2SO4 – (নাইট্রোজেনের মাত্র ২১ শতাংশ) ও (P, Os) (ফসফেটের মাত্র ১৬ শতাংশ)। এখানকার জলাশয়ে পটাশিয়ামের অভাব নেই। বললেই চলে।
জলাশয়ে অজৈবসার ব্যবহার- (একশতকে ৩ ফুট গভীরতায়)
- ইউরিয়া --------------প্রথমে ২৫০ গ্রাম, প্রতিমাসে ৫০ গ্রাম
- অথবা অ্যামোনিয়াম সালফেট--------প্রথমে ৫০০ গ্রাম, প্রতিমাসে ১০০ গ্রাম,
- সিংগল সুপার ফসফেট----------------প্রথমে ৩০০ গ্রাম, প্রতিমাসে ৭৫ গ্রাম
- ম্যাঙ্গানিজ সালফেট-----------আঁতুড় পুকুর ও পালন পুকুর চাষের শুরুতে একবার ৫-১০ গ্রাম।