মাছ চাষের পুকুরে হাঁস-মুরগির সমন্বিত (Integrated) চাষ একটি সহজ বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি যার মাধ্যমে অল্প খরচে মাছের সাথে হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংসের ব্যবস্থা হয়ে যায়। এই ব্যবস্থায় মাছের জলাশয়ে সারের প্রয়োজন হবে না। শুধুমাত্র চুন ও বিশেষ প্রয়োজনে মাছের পরিপূরক খাবার লাগবে। তবে হাঁস-মুরগির পালন প্রযুক্তি মেনেই করতে হবে। সমন্বিত চাষের জলাশয় ৩০ থেকে ৫০ শতক হলে সাধারণ মাছচাষির পক্ষে সহায়ক হয়। তবে চাষির আর্থিক অবস্থা ভাল হলে বড় জলাশয়েও করা সম্ভব। এই ব্যবস্থায় জলাশয় নির্বাচন করার পর হাঁস বা মুরগির সংখ্যা ঠিক করে নিতে হবে। প্রতি শতক জলাশয়ের জন্য দুইটি পাখি হলেই হবে, অর্থাৎ দুইটি হাঁস অথবা মুরগি। দু'রকমের হলে ১টি হাঁস, ১টি মুরগি রাখা যেতে পারে। তবে একরকম হলেই পরিচর্যা করা সুবিধা। পাখিদের সংখ্যা ঠিক করার পর প্রথমেই এদের বাসা বা ঘর করে নিতে হবে। পাখি প্রতি ০.৩-০.৪ বর্গমিটার জায়গা থাকা দরকার এবং জলাশয়ের পাড়ে অথবা জলের উপর মাচা করে ঘর করতে হবে। শক্ত বাঁশ বা লোহার পাইপের খুটিতে জলতল থেকে অন্তত ২-৩ ফুট উচ্চতায় পাটাতন বানিয়ে ঘরের কাঠামো করে নিয়ে চারদিক ঘিরে নিতে হবে। উপরে আচ্ছাদন খড় বা হাল্কা কিছু যেমন—বাঁশের চটার (Bamboo split) উপর পলিথিন চাদর (Sheet) বিছিয়ে করে নিতে হবে। জলাশয় নিজস্ব হলে স্থায়ী ব্যবস্থা করাই ভাল। মেঝের পাটাতন ফাঁকরেখে করতে হবে যাতে পাখির মল সরাসরি জলে পড়ে। নাহলে মেঝের মল প্রতিদিন ধুয়ে জলে দিতে হবে। ঘর আলো-বাতাসযুক্ত হতে হবে। মাংসাশী প্রাণী, বনবিড়াল, কুকুর, ভাম, শিয়াল থেকে পাখিগুলি রক্ষার জন্য ঘর যথেষ্ট মজবুত হওয়া চাই।
মাছের সাথে হাঁস-মুরগি পালন |
মাছচাষের জলাশয়ে সারাবছর জল রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে। চাষের শুরুতে জলাশয় আগাছামুক্ত করতে হবে। তারপর চুন দিতে হবে। সারের প্রয়োজন হবেনা। একটি পাখি দৈনিক গড়ে ২০০ গ্রাম মল ত্যাগ করে। সুতরাং ৬০টি পাখি থাকলে গড়ে ১২ কেজি মল বা জৈবসার প্রতিদিনে পুকুরে যাবে যা মাছ চাষের ৩০ শতক জলের পক্ষে যথেষ্ট। রুই কাতলা, সিলভার কার্প, পুঁটি, সাইপ্রিনাস, মৃগেল প্রজাতির চারা (গড়ে ৫০ গ্রাম, সিলভার কার্প ১০০ গ্রাম) মিশ্র মাছ চাষের অনুপাতে ছাড়তে হবে। মাছ ছাড়ার পর পাখি রাখতে হবে। জলাশয়ে অন্য কোন সার লাগবে না। জল হাল্কা সবুজ বা নীল না হলে মাছের জন্য খাবারের প্রয়োজন হতে পারে। মাসে মাসে চুন ও জাল দিতে হবে। জলাশয়ের তলদেশ মাঝেমধ্যে ঘেঁটে (Rake) দেওয়া দরকার। বিক্রি করার মত হলে মাছ তুলে আবার চারা ছাড়তে হবে। হাঁস-মুরগির ডিম যখন যেমন হবে তা সংগ্রহ করে বাজার জাত করতে হবে। ব্রয়লার ৪-০-৪৫ দিনের হলে বাজারজাত করে আবার নতুন করে পালতে হবে। ডিম পাড়া পাখিদের একভাবে প্রায় দুই বছর পর্যন্ত রেখে ডিম নেওয়ার পর বিক্রি করে দিতে হবে। আবার নতুন পাখি রাখতে হবে। মাছচাষ সারাবছর চলবে।
পাখিদের খাবার তৈরির জন্য কুঁড়ো, খুদ, বাদামখোল, ভুট্টার গুঁড়ো, গমভাঙা কুচি, শুকনো মাছের গুঁড়ো, ঝিনুক, শামুকের খোলার কুচি (হাতের কাছে যা সহজে পাওয়া যায় এমন) এবং এর সঙ্গে খনিজ উপাদান, ভিটামিন মিশিয়ে নিলে হবে। উপাদানের অনুপাত এরকম হতে পারে-
Fish and duck Farming |
পাখিদের মধ্যে হাঁস (খাঁকি ক্যাম্পবেল বা ইন্ডিয়ান রানার) ও মুরগি (লেগহর্ন, রোড আইল্যান্ড রেড, ব্রয়লার ও বনরাজা) পালন করা যাবে। উপরোক্ত প্রজাতির (ব্রয়লার বাদে যে-কোনো একটির) ৩-৪ মাস বয়সের বাচ্চা পাওয়া গেলে সবচেয়ে কারণ ৫-৬ মাস বয়স থেকেই হাঁস-মুরগি (ব্রয়লার ছাড়া) ডিম দেওয়া শুরু করে। ব্রয়লার ছোট বাচ্চা দিয়ে শুরু করতে হবে। পাখিদের নিয়ম অনুসারে টিকা দিয়ে নিতে হবে। পঞ্চায়েতের প্রাণীসম্পদ উন্নয়ন বিভাগে এর ব্যবস্থা আছে। পাখি রাখার পর থেকেই খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারের দানা খাবার (Mash) দেওয়া সম্ভব না হলে বাড়িতে তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে। খাবার গড়ে ১৫০ গ্রাম করে দৈনিক পাখি প্রতি দিতে হবে। ডিম দিতে আরম্ভ করলে খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। মুরগি আবদ্ধ রেখে ও হাঁস ছেড়ে রেখে পালতে হবে। ইসি পুকুরের জলে চরে জলজ উদ্ভিদ, পোকামাকড়, গেড়ি, গুগলি খাবে। সেক্ষেত্রে তার খাবার কিছু কম দিলেও চলবে।
হাঁসের খাদ্য -
গমের ভুষি ২০০ গ্রাম,কুড় ৩০০ গ্রাম, ফিসমিল ১২৫ গ্রাম, খুদ ২০০গ্রাম, সয়া খোল ১০০ গ্রাম, হারগুড়ো ৫০ গ্রাম, কনিজ লবণ ২০ গ্রাম, খাদ্য খাদ্য প্রান ৫ গ্রাম।
মুরগির খাদ্য-
ভুট্টাভাঙ্গা ২০০ গ্রাম, গমের কুচি ২৫০ গ্রাম, খুদ ১৭৫ গ্রাম, বাদাম খোল ২০০ গ্রাম, শুকনো মাছ কুরো ১০০ গ্রাম, হারগুড়ো ৫০ গ্রাম, খনিজ লবণ ২০ গ্রাম, খাদ্য প্রান ৫ গ্রাম।