বাগদা চিংড়ি চাষ
বাগদা (Shrimp, Penaeid Prawn) আমাদের দেশীয় নোনাজলের চিংড়ি হিসাবে বাগদা চিংড়ি সবচেয়ে বড় প্রজাতির। বাগদা চিংড়ি খাদ্য হিসাবে ও চাষযোগ্য প্রজাতি হিসাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন্স দেশগুলোতে পাওয়া যায়। এদের দ্বিতীয় উদর খণ্ডকের খোলস কেবলমাত্র তৃতীয় উদর খণ্ডকের খোলসকে আংশিক ঢেকে রাখে। প্রথম তিনটি বক্ষ উপাঙ্গ দাড়াবিশিষ্ট। খঙ্গের উপরে ৬-৮টি ও নীচে ২-৪টি দাঁত থাকে চারা অবস্থায় শিরস্ত্রাণের উপর ৬-৮টি আনুভূমিকভাবে সমান্তরাল কালো দাগ থাকে।
বাগদা চিংড়ি (Penaed prawn) সমুদ্রে জন্মায় ও সমুদ্রেই বসবাস করে। সমুদ্র উপকূলের সর্বত্র এদের দেখা পাওয়া যায়। এদের অনেকগুলি প্রজাতি আছে। তার মধ্যে বড় প্রজাতির এবং যার চাহিদা সবচেয়ে বেশি, বিশেষ করে বিদেশিদের কাছে, তা হল টাইগার প্রণ (Tiger prawn), বৈজ্ঞানিক নাম Penaeus monodon দেহের গঠন গলদার তুলনায় সরু এবং লম্বা। পেটের সন্তরণ পদে লাল সবুজ ও হলুদ রঙের দাগ থাকে। শিরোবক্ষের অগ্রভাগে খঙ্গ বা করাত থাকে, তা ছোট ও সরল। নোনা জলে এই প্রজাতির চাষই বেশি প্রচলিত। চাহিদাও সর্বদা তুঙ্গে, তাই চাষ খুবই লাভজনক।
সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা, নদী মোহনা (estuary) সংলগ্ন জলাভূমি যেখানে জোয়ার ভাটা খেলে এমন খাল বা ভেড়ি, লবণতা (salinity) ৫ পিপিটির উপরে, সেখানেই বাগদা চাষ ভাল হবে। নোনা জলের উৎস আছে এমন জমিতে উঁচু বাঁধ দিয়ে ঘিরে জল আনা ও বের করে দেবার ব্যবস্থা রেখে ও সমতল তলদেশে দেখে খামার বা চাষের জলাশয়। নির্বাচন করা উচিত। জলাশয়ের আয়তন ৫০-১০০ শতক হলেই সবচেয়ে ভাল, বেশি হলেও চলবে।
বাগদা চিংড়ি চাষের পুকুর
জলাশয় চাষযোগ্য বা পাট করতে হলে প্রথমেই চাষ ভূমির তলদেশ ৬-৮ ইঞ্চি কালো মাটি (Black soil) তুলে দিয়ে রোদে ভাল করে শুকিয়ে নিতে হবে। তারপর শতক প্রতি ১ কেজি পোড়া চুন ও ২০ – ২৫ কেজি গোবর, অথবা ৩–৪ কেজি বিশুদ্ধ মুরগি মল ছড়িয়ে লাঙ্গল দিয়ে মিশিয়ে দিয়ে ৭-১০ দিন ফেলে রাখতে হবে। এবার নোনা জল ছেঁকে ১ ফুট উচ্চতায় ভরিয়ে নিতে হবে। ঐ জলে শতক প্রতি ২০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম সিঙ্গল সুপার ফসফেট ছড়িয়ে ভাল করে ঘেঁটে দিয়ে ৭ দিন ফেলে রাখতে হবে। ৭-১০ দিন পরে জলাশয়ের জল সবুজ বা বাদামি হলে জল বাড়িয়ে ২১%, – ৩ ফুট করতে হবে। জলের অন্যান্য গুণাবলী পোনা মাছ চাষের মত হলেও লবণতার মাত্রা ১০-২০ পিপিটির মধ্যে রাখতে হবে। জলে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখার জন্য বাগদা চাষের পুকুরে বায়ু সঞ্চালক যন্ত্র অবশ্যই চালাতে হবে।
![]() |
বাগদা চিংড়ি |
বর্ষার শুরুতে বাগদার প্রজনন হয়। পরবর্তী সময়ে উপকূলবর্তী এলাকা সুন্দরবনাঞ্চলের মোহনায় নদী খাল ও খাঁড়িতে প্রচুর পরিমাণে মীন পাওয়া যায়। সেখান থেকে মীন অথবা পি. সি. আর. পরীক্ষিত স্বীকৃত হ্যাচারির মীন কিনে চাষ করা উচিৎ। শুধুমাত্র বাগদা চাষে ২-৩ গ্রাম ওজনের শতকে ৪০০-৫০০টি ও মিশ্রচাষে (ভাঙ্গন, পারশে সহ) চাষে ২৫০-৩০০টি মীন ছাড়ার নিয়ম আছে। মীন পরিবহন করে এনে শোধন ও ধাত সহনশীল করে সকালে অথবা সন্ধ্যায় ছাড়তে হবে। বাগদার প্রকৃত খাদ্য হল জলজ উদ্ভিদ ও শেওলা, বিভিন্ন লবণাক্ত পরিবেশে এরা জন্মায়।
- (ক) ল্যাবল্যাব (Lablab) : অতি লবণাক্ত জলাশয়ের অগভীর তলদেশে জন্মায় যে শ্যাওলা (মিক্সোফাইসি)।
- (খ) লুট (Lumut) : স্বল্প লবণাক্ত জলে জন্মায় এক ধরনের সবুজ সুতাকৃতি শ্যাওলা (ক্লোরোফাইসি)।
- (গ) দিগমান (Digman) : ছোট ছোট জলজ গুল্ম অল্প লবণাক্ত পরিবেশে তলদেশে ঝোপের মত জন্মায় (ম্যাক্রোফাইটস্)।
তবে এসবের ওপর নির্ভর করে বাগদার ফলন ভাল হয় না। পরিপূরক সুষম খাবারের প্রয়োজন। ভাল খাবার হলে ফলন অনেকগুণ বেড়ে যায়। বাদাম খোল, সয়াবিন খোল, ভালো কুঁড়ো (bran), চালের খুদ, ফিসমিল, কুঁচো চিংড়ির শুকনো গুঁড়ো, খনিজ লবণ ও ভিটামিনের আনুপাতিক মিশ্রণ খুবই ফলদায়ক। তবে তৈরি খাবারের ঝামেলা এড়িয়ে বাজারের দানা খাবার (pellets) দেওয়াই ভাল। শুরুতে (starter) বৃদ্ধিতে (grower), সমাপ্তির ফসলে (finisher) নিয়মিত সকালে মোট খাবারের ৪০ ভাগ ও সন্ধ্যায় ৬০ ভাগ দিলেই আশানুরূপ ফলন হবে। প্রতি ৭ দিনে চিংড়ির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দরকারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিচর্যাই অধিক ফলনের চাবিকাঠি। জোয়ারের টাটকা নোনাজল চিংড়ির দারুন উপকার করে। তাই ১৫ দিন অন্তর বর্ষাকালে উপরের জল, অন্য সময়ে জলাশে • তলদেশের জল খানিকটা (৩০ শতাংশ) বদল করে জোয়ারের জল ভরানো দরকার। চিং ৫-৬ মাসের চাষ, কিন্তু ৪ মাস পর থেকেই বাজারজাত করা যায়। ২৫-৩০ গ্রাম জন হলেই ভাল দাম পাওয়া যায়। বাগদা রাত চরা। রাতে খোলস বদলের মাধ্যমে বেড়ে যা নীরোগ, সবল হলে খাবার ও পরিবেশের প্রভাবে বড় হবার সময় নির্দিষ্ট নিয়মে খোলস বদল করে। সাধারণত ছাড়ার সময় ২ গ্রাম থেকে ১০ গ্রাম পর্যন্ত ১৫-১৭ দিন অন্তর খোল বদলায়। ৫০-৭০ গ্রাম বৃদ্ধি পর্যন্ত ২০-২৫ দিন অন্তর খোলস বদল করে। তখন এদের আত্মরক্ষার জন্য তাল খেজুরের বাগলা ও ডালপালা জলাশয়ে দেওয়া দরকার। বাগদার জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ৪ মিলিগ্রামের কম হলেই সমস্যা তৈরি হয়। তাই অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধির জন্য প্রতিদিন ৩–৪ ঘণ্টা শেষ রাতে মেঘলা দিনে এবং বৃষ্টির দিনে বায়ু সঞ্চালক যন্ত্র বেশি সময় অবশ্যই চালানো দরকার
।
মনে রাখা দরকার বাগদা চিংড়ি অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রোগাক্রান্ত মড়ক লেগে শেষ হয়ে যায়। তাই যথাসম্ভব জলাশয়ও তার চারপাশ যেন দূষণমুক্ত থাকে। রোগাক্রান্ত চিংড়ি তুলে বিক্রি করে দেওয়াই ভাল। বর্তমানে আমেরিকান ও হাইওয়ান প্রজাতির চিংড়ি (ভেনামি লিট্রোপেনাস ভেন্নামাই) চাষ লাভজনক হয়ে উঠেছে।