![]() |
প্রণোদিত প্রজনন |
মাছ আমাদের লোভনীয় ও পুষ্টিকর আহার। বর্তমানে মাছচাষ অর্থকরী অবলম্বন ও রোজগারের সহজপথ। আমিষ খাদ্যবস্তুর মধ্যে পুষ্টিকর হিসাবে তুলনাহীন। মাছচাষের বিকল্প কোনো চাষ নেই। মাছচাষ সারাজীবনের জীবিকা সহায়ক। বিজ্ঞান প্রযুক্তিবলে মাছচাষ এখন অনেক উন্নত, প্রসারিত এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার দিশারি। কাচের জলাধারে বা চৌবাচ্ছায় শৌখিন মাছ চাষ একরকম, আর পুকুরে বা জলাশয়ে উন্নত প্রযুক্তি মেনে মাছ চাষ করে ফলন তোলা অন্য জিনিস। প্রথমক্ষেত্রে আমাদের শখ বা বিনোদন, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আমিষ পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান ও জীবিকার উৎস। উভয়ক্ষেত্রের মূল উপাদান হল মাছের চারা। এই সুস্থ ও সবল মাছের চারা সংগ্রহ হয়। উন্নতমানের প্রজনন বা
বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে। জীবের একটি বৈশিষ্ট্য হল বংশবৃদ্ধি করে পরবর্তী প্রজন্মের সূচনা করা। মাছের প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই বংশধারা বা ক্রমবিকাশ পরম্পরা মেনেই চলে আসছে।
মাছেদের বংশরক্ষা হয় যৌনজনন (Sexual reproductivity) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যেখানে পরিণত, সুস্থ ও সবল স্ত্রী ও পুরুষ মাছের প্রয়োজন। স্ত্রী মাছ বয়সকালে নির্দিষ্ট নিয়মে গর্ভধারণ করে। ডিম্বাণু পরবর্তীকালে পরিপুষ্ট ডিম এবং পুরুষ মাছও ঠিক একই নিয়মে শুক্রাশয়ে শুক্রাণু ধারণ করে। পরিণত মাছেরা প্রজনন মরশুমে উপযুক্ত পরিবেশে স্রোতের জলে অথবা বদ্ধ জলাশয়ে মিলিত হয় এবং ডিম প্রসব করে। আর কিছুমাছ সরাসরি বাচ্চা দেয়। তখন পুরুষ মাছেরা ওই ডিমগুলিকে গর্ভাশয়ের বাইরে ও ভিতরে শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত করে। নিষিক্ত ডিম প্রাকৃতিক পরিবেশেই ফুটে ডিমপোনায় পরিণত (Hatchling বা Spawn) হয়। অধিকাংশ মাছের অপত্যস্নেহ নেই, আবার আছে।
আমাদের জানা ২-৩ হাজার দেশি-বিদেশি মাছের মধ্যে বিশেষ কতকগুলি মাছ পালন বা চাষের কাজে ব্যবহৃত হয়। চাষযোগ্য মিষ্টিজলের মাছেদের প্রজননক্ষেত্র যথা প্রাকৃতিক পরিবেশ, কিন্তু নদীর বহমান প্রজননস্থলের অবস্থা খারাপ হওয়ায় এদের বীজ প্রাকৃতিকভাবে প্রয়োজনমত পাওয়া যায় না। এদের প্রণোদিত প্রজননের মাধ্যমে কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করে চারা উৎপাদন করা হয়। সামুদ্রিক মাছের প্রায় সবটুকুই প্রাকৃতিকভাবে আহরণ করতে হয়। কৃত্রিম উপায়ে সামুদ্রিক চাষযোগ্য মাছের বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি এখনও অনুসন্ধান ও গবেষণার পর্যায়ে আছে।
স্বাদু বা মিঠাজলের চাষযোগ্য মাছেদের সংখ্যাও হাতে গোনা কয়েকটি। শৌখিন মাছের (Ornamental fish) বেশিটাই বিদেশ থেকে আমদানি করা। তবে বর্তমানে এদের প্রজনন করিয়ে বাচ্চা তোলার প্রয়াস চলছে। চাষযোগ্য দেশি মাছগুলি হল, রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউস, বাটা, সরলপুঁটি, মাগুর, কই, পাবদা, পায়রাচাঁদা, চিতল, শাল, শোল ইত্যাদি। আর বিদেশিমাছগুলি হল সিলভারকার্প, গ্রাসকার্প, সাইপ্রিনাসকার্প, মাডকার্প, ব্ল্যাককার্প, পাঙ্গাস, জাভাপুঁটি, তিলাপিয়া, গোরামি, পাকু (রূপচাঁদা), ভিয়েতনাম কই ইত্যাদি।
উপরোক্ত দেশি ও বিদেশি মাছের প্রণোদিত বা কৃত্রিম উপায়ে প্রজনন করাতে হলে প্রাথমিকভাবে করণীয় কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দেশে বিশেষ করে উভয় বাংলায় বর্ষাকাল হল ওই সকল মাছের প্রজনন ঋতু। কিন্তু ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রয়োজনে এদের প্রজননকালের স্থায়িত্ব দীর্ঘায়িত হয়েছে। অর্থাৎ প্রাক্-বর্ষা যথা এপ্রিল-মে থেকে বর্ষার শেষ আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রজনন করিয়ে নেওয়া হয়।
প্রণোদিত বা কৃত্রিম ব্যবস্থা নিয়ে এদের প্রজনন করাতে হলে শুরুতেই বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নিয়ে এদের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির সাথে প্রজননক্ষম করে তোলা দরকার। তাই প্রজনন ঋতুর নির্ধারিত সময়ের অন্তত ৯০দিন আগে থেকে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউস, সিলভারকার্প, গ্রাসকার্প ইত্যাদির ক্ষেত্রে পুরুষ ও স্ত্রী মাছ বাছাই, যথা প্রাপ্তবয়স ও শারীরিক পরিপূর্ণতার প্রেক্ষিতে ডিম প্রসবের উপযুক্ত ও নিষিক্তকরণের ক্ষমতার উন্মেষ ঘটানো খুবই জরুরী। প্রজননক্ষম মাছের এই পরিচর্যার দ্বারা উন্নতমানের ডিমপোনা ও উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা হয়। অন্যথায় আশানুরূপ সুস্থ, সবল ও অধিক ডিমপোনা পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।
রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবোস, বাটা, সিলভার কার্প, গ্রাসকার্প ইত্যাদি চাষযোগ্য (cultivable species) মাছেরা বদ্ধজলে অর্থাৎ পুকুরে ডিম পাড়েনা। বর্ষাকালে নদীতে স্রোতের জলে ডিম পাড়ে। সেই ডিম ফুটে বাচ্চা হবার পর নদী তীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে এদের ডিমপোনা সংগ্রহ করা হত। এছাড়া মেদিনীপুর ও বাঁকুড়ার কিছু অংশে পুকুরে বা বাঁধে বর্ষাকালে দেশি কার্প মাছেরা ডিম পাড়তো। ঐ বিশেষ বাঁধগুলো ছিল দুই ধরনের—শুকনো বাঁধ ও জল থাকা বাঁধ। ঐ সকল বাঁধের বৈশিষ্ট্য ছিল যে বর্ষাকালে চারিদিকের উঁচু অংশ থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে বাঁধগুলোয় ঢুকতো ও অধিক জল অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যেতো। অবিরত বর্ষার সময় বাঁধের মালিক বা মাছচাষি এর মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবোসের প্রজননক্ষম (Matured) মাছ ছেড়ে দিলে তারা সেখানে ডিম পেড়ে দিত। পরদিন সকালে মিহিজালে ঐ ডিম ছেঁকে নিয়ে বাঁধের পাড়ে অনেক মাটির গর্তে (২ × ১.৫'×১০") পালন করা হত। গর্ত বা চৌকো বা হাপাগুলি (Hapas) কয়েক সারিতে করা হত এবং মধ্যে এক লম্বা নালা কেটে তারমধ্যে জল সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা হত। প্রতি গর্তে ১ লিটার ডিম (৪-৫ মিমিঃ গড়ে ২০,০০০ সংখ্যক) পালন করা হত। বারবার জল বদল ও নাড়াচাড়া করার ফলে রাতের মধ্যেই বাচ্চা ফুটে যেত। সেই বাচ্চা তিনদিন পর ডিব্বা/ছিপি মেপে বিক্রি হত আঁতুরে পালন করার জন্য। এখন আর ঐভাবে ডিমপোনা (spawn) করা হয়না বললেই চলে।
১৯৫৫ সালে প্রথিতযশা মৎস্যবিজ্ঞানী ডঃ হীরালাল চৌধুরী প্রথম দাঁড়কে মাছে (Esomus danricas) পিটুইটারি হরমোন প্রয়োগ করে হাপায় ডিম পাড়াতে সক্ষম হন। পরবর্তীকালে ১৯৫৭ সালে তিনি মৃগেল, রুই, বাটা ও পুঁটিমাছের ডিম ঐভাবে পাড়ান এবং সেই পদ্ধতিতেই মৎস্যবীজ পাওয়ার সহজ দরজা খুলে গেল মাছ চাষের ইতিহাসে। ১৯৫৭-র ১০ই জুলাই, সেই দিনটি তাই মৎস্যচাষি দিবস হিসাবে পরিগণিত। এই পদ্ধতি হল প্রণোদিত প্রজনন বা Induced breeding। সেই শুরু হল প্রজননক্ষম মাছের পিটুইটারি গ্রন্থির হরমোন প্রয়োগ করে প্রয়োজনীয় মৎস্যবীজ উৎপাদন। এখন এই পদ্ধতির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু মূল ভাবনা বা প্রযুক্তি এক আছে।
মাছের পিটুইটারি গ্রন্থির হরমোন |