অভিব্যক্তি বা বিবর্তন
ল্যা 'টিন শব্দ 'Evolveri' থেকে Evolution কথাটির উৎপত্তি হয়েছে, এর অর্থ ‘ক্রমবিকাশ’। ইংরেজ দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ হার্বার্ট স্পেনসারের মতে, কোনও সত্তার বিকাশ যখন মন্থর অথচ গতিশীল ও পর্যায়ক্রমিক ভাবে ঘটে এবং নির্দিষ্ট সত্তা সরল অবস্থা থেকে জটিল অবস্থায় পরিণত হয়, তখন ওইরকম পরিবর্তনকে ‘ইভোলিউশন' (Evolution) বা অভিব্যক্তি বলে।
অভিব্যক্তি কী? (What is Evolution?) :
→ পৃথিবীতে প্রথম উৎপন্ন জীব ছিল এককোষী এবং সরল প্রকৃতির। ওই এককোষী সরল জীব থেকে ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত জটিল বহুকোষী জীবের সৃষ্টি হয়। এরপর যুগ-যুগ ধরে ক্রমাগত পরিবর্তনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে আধুনিক কালের জীবসমূহের উৎপত্তি হয়েছে। ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সরল জীব থেকে জটিল জীব সৃষ্টি হওয়ার এই পদ্ধতিই হল জৈব বিবর্তন বা জৈব অভিব্যক্তি।
• অভিব্যক্তির সংজ্ঞা : যে মন্থর কিন্তু অবিরাম গতিশীল প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিক পরিবর্তন ও ক্রমিক রূপান্তরের মাধ্যমে পূর্বপুরুষ অর্থাৎ সরল উদ্ংশীয় জীব থেকে নতুন ও অপেক্ষাকৃত জটিল জীবের উদ্ভব এবং ক্রমবিকাশ ঘটে, তাকে জৈব অভিব্যক্তি বা জৈব-বিবর্তন বলে।
অভিব্যক্তির তত্ত্বাবলী (Theories of Evolution) :
অভিব্যক্তির ফলে নতুন প্রজাতির অথবা একটি প্রজাতি থেকে অন্য একটি প্রজাতির উৎপত্তি হয়। অভিব্যক্তির কৌশল সম্পর্কে যে সব বিজ্ঞানী বিভিন্ন তত্ত্বাবলী (theories) প্রতিষ্ঠিত করেছেন তাঁদের মধ্যে ল্যামার্ক এবং ডারউইনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে অভিব্যক্তির বিভিন্ন তত্ত্বাবলী সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
ল্যামার্কের তত্ত্ব (Theory of Lamarck) : ল্যামার্ক সর্বপ্রথম অভিব্যক্তির ওপর বিশ্লেষণী তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন এবং বিষয়টি 1809 খ্রিস্টাব্দে তাঁর লেখা 'ফিলোসফিক জুওলজিক' নামে একটি বইতে লিপিবদ্ধ করেন। ল্যামার্কের তত্ত্বকে ল্যামার্কিজম বা ল্যামার্কবাদ বলে। কয়েকটি প্রধান প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে ল্যামার্কবাদ গঠিত হয়েছে। অভিব্যক্তি সম্পর্কে ল্যামার্কের মতবাদের প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো নীচে আলোচনা করা হল
[1] ব্যবহার ও অব্যবহারের সূত্র (Law of use and disuse) : ল্যামার্কের মতে, জীবের প্রয়োজনে জীবদেহে কোনও নতুন অঙ্গের উৎপত্তি অথবা কোনও পুরানো অঙ্গের অবলুপ্তি ঘটতে পারে। তাঁর মতে, যদি কোনও জীবের কোনও অঙ্গ ধারাবাহিকভাবে ক্রমাগত ব্যবহৃত হয়, তবে সেই অঙ্গ পরিবেশের প্রয়োজনীয়তার জন্য ধীরে ধীরে সবল ও সুগঠিত হবে। অন্যদিকে, জীবের কোনও অঙ্গ পরিবেশের পক্ষে অপ্রয়োজনীয় হলে ওই অঙ্গের আর ব্যবহার থাকে না – সুতরাং ক্রমাগত অব্যবহারের ফলে অঙ্গটি নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হবে এবং অবশেষে অবলুপ্ত হয়ে যাবে।ল্যামার্কের মতে অঙ্গের ব্যবহার ও অব্যবহার জীবদেহে পরিবর্তন সূচিত করে, যা জীবের বংশপরম্পরায় অর্জিত বৈশিষ্ট্য।
[2] পরিবেশের প্রভাব এবং জীবের সচেষ্টতা (Efforts) : সদা পরিবর্তনশীল পরিবেশে জীব নিজেকে উপযুক্তরূপে মানিয়ে নেবার জন্য সব সময় চেষ্টা করে। এটি জীবের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তনশীল পরিবেশে নিজেকে অভিযোজিত করতে জীবদেহে নানারকম পরিবর্তন দেখা যায়। ল্যামার্কের মতে, জীব সজ্ঞানে, নিজের চেষ্টায় বিশেষ কোনও অঙ্গের বৃদ্ধি অথবা ক্ষয় করে বিবর্তনের ধারা পরিবর্তন করতে পারে। এটাও একটি জীবের অর্জিত বৈশিষ্ট্য।
[3] অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ (Inheritance of acquired characteris): ল্যামার্কের মতে, কোনও জীবের জীবনকালে যে সমস্ত বৈশিষ্ট্য অর্জিত হয়, সেই সমস্ত বৈশিষ্ট্য এক জনু থেকে অপর জনুতে সঞ্চারিত হয়, অর্থাৎ অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ ঘটে।
(4) নতুন প্রজাতির উৎপত্তি (Origin of new species) : ল্যামার্কের তত্ত্ব অনুযায়ী অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণের জন্য এবং প্রতিটি জনুতে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য অর্জিত হওয়ায় ধীরে ধীরে একটি প্রজাতি থেকে অপর একটি নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়।
* ল্যামার্কের মতবাদের স্বপক্ষে উদাহরণ (Examples in favour of Lamarckism) :
1. ক্রমাগত জলে সাঁতার কাটার ফলে জলজ পাখির পা, পায়ের আঙুলের অন্তর্বর্তী স্থানগুলো পাতলা চামড়া দ্বারা সংযুক্ত হওয়ায় লিপ্তপদে পরিণত হয়েছে।
2. সাপের পূর্বপুরুষদের গিরগিটির মত চারটে পা ছিল, কিন্তু ভূগর্ভ অভিযোজনের জন্য পায়ের ক্রমাগত অব্যবহারের ফলে বর্তমানে ঐ বৈশিষ্ট্যটি সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হয়েছে।
3. উটপাখির পূর্বপুরুষদের সক্রিয় ডানা ছিল এবং তারা আকাশে উড়তে পারত, কিন্তু বংশানুক্রমে ডানার ব্যবহার না থাকায় সেটি এখন লুপ্তপ্রায় অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
4. ল্যামার্কের মতে জিরাফের সুদীর্ঘ গ্রীবা, খুব উঁচু গাছ থেকে পাতা সংগ্রহের জন্য, অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণের ফলেই ঘটেছে।
→ উদ্ংশীয় জিরাফ খর্ব গ্রীবাযুক্ত এবং স্বভাবগত তৃণাচারী (grazing) প্রাণী ছিল। এই ধরনের প্রাণীর পরিবেশে তৃণ ও বীরুৎজাতীয় উদ্ভিদদের ক্রমশ ঘাটতি ঘটায়, তারা অপেক্ষাকৃত উঁচু গাছের উঁচু ডালের পাতা খেতে শুরু করে। উঁচু গাছের পাতা নাগাল পাওয়ার জন্য উদ্বংশীয় জিরাফের গ্রীবা ও অগ্রপদ দুটি লম্বা হতে থাকে। দেহের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে গ্রীবার ক্রমপ্রসারণের ফলে অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণের মাধ্যমে খর্ব গ্রীবাযুক্ত উদ্বংশীয় জিরাফ থেকে বর্তমানকালের দীর্ঘ গ্রীবাযুক্ত জিরাফের উৎপত্তি ঘটে।
ল্যামার্কের মতবাদের বিপক্ষে পরীক্ষা (Experiments against Lamarckism) :
1. বিজ্ঞানী ভাইসম্যান (Weismann) ল্যামার্কের মতবাদকে তার ইঁদুরের ওপর পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে নাকচ করে দেন। তিনি একজোড়া ইঁদুর দম্পতির লেজ কেটে দেন। তাদের সন্তান জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে সন্তানগুলিরও লেজ তিনি কেটে দেন। এইভাবে 35 জনু (generation) ধরে ইঁদুরের লেজ কাটা সত্ত্বেও তিনি একটিও লেজবিহীন ইঁদুর জন্মাতে দেখেন নি এবং স্বাভাবিক কারণেই ল্যামার্কের তত্ত্বকে অস্বীকার করেন।
2. ড্রসোফিলা (Drosophila) মাছিকে পরপর 60 জনু ধরে সম্পূর্ণ অন্ধকার ঘরে জনন কার্য পরিচালনা করা সত্ত্বেও তাদের কেউই দৃষ্টিশক্তিহীন হয়ে জন্মগ্রহণ করেনি।