বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপি Bengali language and Bengali script in bengali

বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপি

 বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপি

বাংলাদেশের চতুঃসীমার মধ্যে যে ভাষার বিবর্তন হয়েছে, যা বাঙালির হাজার বছরের চৈতন্যপ্রবাহ বহন করে চলেছে, সেই বাংলা ভাষার উৎসস্থল সংস্কৃত সন্দেহ নেই। গিরিদরী থেকে যখন ক্ষীণ ধারায় জলস্রোত নেমে আসে, তখন তাকে দেখে কি মনে হয়, এই শীর্ণ তোয়প্রবাহ ক্রমে সমতলভূমিকে প্লাবিত করে প্রবল বিক্রমে, প্রচণ্ড উচ্ছ্বাসে, দিগ্‌-দিগন্ত কাঁপিয়ে সমুদ্রে মিলিত হবে? বাংলা ভাষার উৎপত্তি অন্যান্য ভারতীয় আর্যভাষার মতোই নদীপ্রবাহের সঙ্গে তুলনীয়। নদীপ্রবাহের মতোই এ ভাষা কালানুক্রমিকভাবে যত অগ্রসর হয়েছে, ততই এর পরিবর্তন হয়েছে, ততই এর আকার-আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে। তারপর এই বিংশ শতাব্দীতে এ ভাষা সহস্রমুখী হয়ে চলেছে নব নব সম্ভাবনার সাগরসঙ্গমে। অবশ্য সম্প্রতি রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ দ্বিখণ্ডিত হলেও ভাষার বিচারে অখণ্ডতাই আমাদের লক্ষ্য। আগের আলোচনায় আমরা দেখেছি, এ-দেশে আর্যাভিযানের পূর্বে অস্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত নিষাদ জাতি বাস করত। কালক্রমে এ-দেশে আর্যসংস্কার দৃঢ়মূল হল, আর্যভাষা অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষা বাঙালির অধিগত হল, তারপর স্বাভাবিক নিয়মে প্রকৃত ও অপভ্রংশ ভাষাও এ-দেশে প্রচলিত হল—এবং সংস্কৃত-প্রাকৃত-অপভ্রংশের খোলস ছেড়ে খ্রীস্টীয় দশম শতাব্দীর দিকে বাংলা ভাষা ভূমিষ্ঠ হল–অবশ্য এ তারিখ আরও কিছু পিছিয়ে বাংলা ভাষার পরিণতিপ্রবাহ ধরে উৎসমুখে এগিয়ে যাওয়া যাক। 
বাংলা ভাষা যে মূল ভাষা থেকে জন্ম নিয়ে পূর্ব-ভারতের সমতলভূমির ওপর দিয়ে বয়ে  গেছে, ভাষার ইতিহাসে তাকে ইন্দোয়ুরোপীয় ভাষামুল বলে। পশ্চিমী পণ্ডিতেরা বলেন খ্রীস্টের জন্মের হাজার দেড়েক বছর আগে (আমাদের মতে, আরও আগে) ইন্দোয়ুরোপীয় ভাষাভাষী প্রাচীন আর্যজাতি ইরান ছেড়ে ভারতের পশ্চিম-পঞ্জাবে উপনিবিষ্ট হয় এবং তারপর হাজারখানেক বছরের মধ্যে পূর্ব-ভারত পর্যন্ত প্রসৃত হয়। এদের ভাষা ভাষাতত্ত্বে আদি ভারতীয় আর্যভাষা নামে পরিচিত। বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষা এর অন্তর্ভুক্ত। এর ব্যাপ্তিকাল খ্রীঃ পূঃ ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রীঃ পূঃ ৬০০ অব্দ পর্যন্ত। এর পর জনতার প্রভাবে এ ভাষার নিয়মকানুন কিছু শিথিল হল, প্রাকৃত জনের অলস অসাড় জিহ্বার জড়ত্বপূর্ণ উচ্চারণের ফলে তৎসম (সংস্কৃত) শব্দেরও কিঞ্চিৎ জাতিনাশ হল। এই পর্বের নাম 'প্রাকৃত ভাষা'। এর আয়ুর পরিমাণ খ্রীঃ পূঃ ৬০০ অব্দ থেকে খ্রীস্টীয় ৬০০ অব্দ। এর প্রথম পর্যায়ের নাম পালি ভাষা (খ্রীঃ পূঃ ৬০০—খ্রীঃ পূঃ ২০০), দ্বিতীয় পর্যায়ের নামই প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃত (খ্রীঃ পূঃ ২০০—খ্রীঃ ৬০০)। পালি ভাষা বুদ্ধদেবের নির্দেশেই জন্ম লাভ করে। তিনি সংস্কৃত ছেড়ে জনসাধারণের ব্যবহৃত প্রাকৃত ভাষায় উপদেশাদি লিপিবদ্ধ করতে আদেশ দেন। অবশ্য পালি ভাষাও খাস জনতার মুখের ভাষা নয়, একেও মিশ্র ভাষা এবং সাহিত্যের ভাষা বলতে হবে। দ্বিতীয় পর্বের প্রাকৃত ভাষা সংস্কৃত নাটকে কোনো কোনো চরিত্রের মুখে প্রযুক্ত হয়েছে, প্রাকৃতে লেখা কাব্য ও নাটকে পাওয়া গেছে। প্রাকৃতের সাহিত্যগৌরব সংস্কৃতের মতো দীর্ঘবিস্তারী না হলেও নিতান্ত তুচ্ছ করবার মতো নয়। অঞ্চলভেদে প্রাকৃতের চারটি স্তর আছে— 

  1. শৌরসেনী প্রাকৃত, 
  1. মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃত, 
  1. মাগধী প্রাকৃত, 
  1. অর্ধমাগধী বা জৈনমাগধী প্রাকৃত। 
এছাড়াও পৈশাচী প্রাকৃত বলে আর একটি প্রাকৃতের নাম শোনা যায় বটে, কিন্তু এতে রচিত কোনো সাহিত্যকর্মের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। এদের মধ্যে শৌরসেনী ছিল শিষ্টজনের ভাষা, একদা উত্তরাপথের lingua fraca। মিঠে বুলির কাব্যকবিতায় সুমধুর মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতের ব্যবহার ছিল প্রসিদ্ধ। মাগধী প্রাকৃত ছিল নাটকে নিকৃষ্ট জনের ভাষা— পূর্ব-ভারতের প্রতি উন্নাসিক আর্য বৈয়াকরণদের তাচ্ছিল্যের দৃষ্টান্ত। আমাদের বাংলা ভাষা এই মাগধীরই উত্তরপুরুষ। প্রাকৃত ভাষায় সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মকানুন শিথিল হলেও এরও একটা বাঁধন ছিল, প্রাকৃতের ব্যাকরণও রচিত হয়েছিল—কিন্তু ব্যাকরণের বাঁধ দিয়ে ভাঙনের হাত থেকে প্রাকৃত ভাষাকে বাঁচানো গেল না। এর পরের যুগে ভাষার নিয়মকানুন আরও শিথিল হয়ে গেল—উচ্চারণ আরও বিকৃতি প্রাপ্ত হল। এই পর্যায়ের নাম অপভ্রংশ—এর কালপরিমাণ খ্রীস্টীয় ৬০০ অব্দ থেকে খ্রীস্টীয় ১০০০ অব্দ পর্যন্ত। প্রত্যেক প্রাকৃত থেকে তার নাম দিয়েই অপভ্রংশের আবির্ভাব পরিকল্পিত হয়েছে। যেমন— শৌরসেনী প্রাকৃত থেকে শৌরসেনী অপভ্রংশের, মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃত থেকে মাহারাষ্ট্রী অপভ্রংশের, মাগধী প্রাকৃত থেকে মাগধী অপভ্রংশের আবির্ভাব হয়েছে। আমাদের বাংলা ভাষা এই মাগধী অপভ্রংশের সন্তান; তার আর কটি সন্তানের নাম: হল—মৈথিলি, মগহী, ভোজপুরিয়া, অসমিয়া ও ওড়িয়া। অপভ্রংশের নিয়ম-না-মানা যুগে প্রাকৃত ব্যাকরণের যৎকিঞ্চিৎ নিয়মবন্ধনও যে শিথিল হয়ে যায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শিষ্টসমাজে শৌরসেনী অপভ্রংশের তবু যৎকিঞ্চিৎ মর্যাদা ছিল, মাহারাষ্ট্রী অপভ্রংশও গীতিকবিতাতে নিতান্ত অপাংক্তেয় ছিল না। কিন্তু মাগধী অপভ্রংশের সাহিত্যগৌরব নেই বললেই চলে। 
এমনকি আঙ্গ-বঙ্গের মাগধী অঞ্চলে মাগধী অপভ্রংশের স্থলে মধ্য ভারতের শৌরসেনী ভাষাই ব্যবহ্রত হত। তবে মাগধী অপভংশের থেকেই বাংলা ভাষার জন্ম হল দশম শতাব্দীতে বা তারও কিছু আগে।
খ্রীস্টীয় দশম শতাব্দী থেকে শুরু করে আধুনিকাল পর্যন্ত নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ো বাংলা ভাষা বয়ে চলেছে। এ ভাষার্কা বয়স অন্যূন হাজার বছর। ভাষাগত পরিবর্তনের চিহ্ন ধরে বাংলা ভাষাকে যথাক্রমে তিন পর্যায়ে বিভক্ত করা যেতে পারে। আদিযুগের ব ভাষা াংলা প্রাচীন বাংলা ভাষার সীমা খ্রীস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ে' এ ভাষার প্রাথমিক দৃষ্টান্ত মিলবে—বলা বাহুল্য সে দৃষ্টান্ত মুখের ভাষার  লেখ্য ভাষার। সে যুগের বাঙালির মুখের ভাষা কেমন ছিল তার কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না। অবশ্য পুঁথির ভাষাও মুখের ভাষার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই যুগের ভাষা থেকে তখনও অপভ্রংশ—এমনকি প্রাকৃতের প্রভাব ঘোচেনি। শৌরসেনী অপভ্রংশ তখন বাংলাদেশের শিষ্টসমাজে প্রচলিত ছিল বলে 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' গ্রন্থে আদিম বাংলার সঙ্গে প্রচুর শৌরসেনী অপভ্রংশের প্রভাব দেখা যায়। এর পর মধ্যযুগের বাংলা ভাষার কাল অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এর বিস্তার। খ্রীঃ এয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের ভাষার বিশেষ কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। কারণ ঐ কালের মধ্যে রচিত কোনো বাংলা গ্রন্থের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাংলা কাব্যে যে-ভাষা ব্যবহ্যত হয়েছে তাকে মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার প্রথম পর্যায় নামে অভিহিত করা যায়। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্য এই যুগের প্রথম গ্রন্থ। এতে দেখা যাচ্ছে, চর্যাপদের পর শ' দুয়েক বছরের মধ্যে বাংলা ভাষার আরও বিবর্তন হয়েছে, অপভ্রংশ প্রাকৃত শব্দের ব্যবহার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, ভাষার ব্যাকরণ ও ধ্বনিতত্ত্বের বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে, কিছু কিছু বিশুদ্ধ তৎসম শব্দও ব্যবহৃত হতে আরম্ভ করেছে। খ্রীঃ ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ, অর্থাৎ ভারতচন্দ্রের মৃত্যু ( ১৭৬০ ) পর্যন্ত মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার অস্ত্র্য পর্যায় বিস্তৃত। এই স্তরে বাংলা ভাষার রূপান্তর প্রায় আধুনিক কালের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে, বৈষ্ণব সাহিত্য ও পৌরাণিক অনুবাদ- সাহিত্যের প্রভাবে ভাষার প্রচুর তৎসম শব্দ (অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দ) প্রয়োগ হতে আরম্ভ করেছে, সঙ্গে সঙ্গে ইসলামি শব্দের ব্যবহারে বাঙালি হিন্দু বেশ রপ্ত হয়ে উঠেছে। বৈষ্ণব পদসাহিত্যে বাংলা মৈথিলি মিশ্রিত ব্রজবুলিরও উল্লেখ করা যেতে পারে। মধ্যযুগের শেষ সক্ষম কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর প্রচুর ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। এরপর ইংরেজ আমল হল, বিদেশি শিক্ষা-সংস্কৃতির বাহনে ইংরেজি ফরাসি-পর্তুগিজ শব্দও বাংলা শব্দভাণ্ডারে স্থান পেল-সর্বোপরি আধুনিককালে বাংলা গদ্য বাঙালির চিত্তপ্রবাহের প্রধান খাতরেখা হয়ে দাঁড়াল। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে কলকাতায় নাগরিক জীবনে সাধু ও চলিতভাষা সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। সাধুভাষা কৃত্রিমভাষা নয়, বা আধুনিককালের পণ্ডিত বা মিশনারি সাহেবদের সৃষ্টি নয়। খ্রীঃ ষোড়শ শতকেও সাধু গদ্যে লেখা চিঠি পত্রাদি পাওয়া গেছে—সাধুভাষার কাঠামোই মধ্যযুগীয় পরার-ত্রিপদীতে অনুসৃত হয়েছে। পরে কলকাতা ইংরেজ যুগের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হলেও নদিয়া শান্তিপুর থেকে কলকাতা পর্যন্ত গাঙ্গেয় অঞ্চলের সভ্যজনের মুখের ভাষার সাহিত্যে ব্যবহৃত রূপ 'চলিতভাষা' নামে সাধুভাষার প্রবল প্রতিদ্বন্ধী হয়ে দাঁড়াল। ইদানীং ক্রমে ক্রমে সাধুভাষা হঠে যাচ্ছে, আর চলিতভাষা সেই স্থান দখল করছেন অল্পদিনের মধ্যেই সাধুভাষার ব্যবহার আরও সংকীর্ণ হয়ে যাবে। বাংলার যে চারিটি প্রধান উপভাষা—রাঢ়ী, বারোধী, কামরূপ ও বঙ্গ—এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণে বঙ্গ অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের ভাষা আজ প্রচলিত হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো পরিবারের ভিতর এর ব্যবহার এখনও আছে বটে, কিন্তু ক্রমেই রাঢ়ভূমির ভাষা একে গ্রাস করবে। কারণ কিছুকাল পূর্বে- পূর্ববঙ্গের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রকার সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রাজনৈতিক কারণেই ছিন্ন হতে বসেছিল—এর ফলে 'বঙ্গের অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের ভাষা রাঢ়ভূমিতে আর প্রবেশাধিকার পাবে না। তা হলেও পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির ধারা ও ভাষা একই। কোনো রাজনৈতিক ছুরি চালিয়েও তাদের বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। উত্তরবঙ্গের ভাষার বিশেষ কোনো সাহিত্যগৌরব নেই—দু-চারটি ছড়া-পাঁচালি ছাড়া। সুতরাং রাঢ়ভূমির ভাষা এ-দেশের একমাত্র ভাষা হয়ে উঠেছে। সাহিত্যকর্মে এই ভাষারই জয়জয়কার। এখন পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের শিষ্টসমাজে, সাহিত্যকর্ম, সভাসমিতি, অভিনয়, ছায়াচিত্র, বেতার ও দূরদর্শনে কলকাতার ভাষাই ব্যবহৃত হয়।
এবার বাংলা লিপির কথা সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। প্রাচীন যুগে পূর্ব-ভারতে অর্থাৎ বাংলাদেশে ব্যবহৃত লিপি বাইরেও গিয়েছিল—এখন এই ধরনের প্রমাণ হস্তগত হয়েছে। তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। একদা বাংলাদেশ থেকে অনেক ধর্মপ্রচারক ভারতের বাইরে চিন-জাপান- যবদ্বীপ প্রভৃতি অঞ্চলে গিয়েছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তদানীন্তন বঙ্গাক্ষরে লেখা পুঁথিপত্র। তাই চিন-জাপান, শ্যাম-কম্বোজের প্রাচীন মন্দিরে বাংলা অক্ষরে লেখা প্রাচীন পুঁথির নিদর্শন পেলে অবাক হবার কিছু নেই—এবং সত্যই ঐ সমস্ত অঞ্চলে প্রাচীন বাংলা অক্ষরের পুঁথি পাওয়া গেছে।
বাংলা লিপির উৎপত্তি, বিবর্তন ও পরিণতির ইতিহাসও কম বিস্ময়কর নয়। বাংলা ভাষা যেমন হাজারখানেক বছর ধরে বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে, তেমনি বাংলা অক্ষরও বহুদিন ধরে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সুগঠিত রূপ লাভ করেছে। পুঁথিপত্রের লিপি স্থায়িরূপ লাভ করল ছাপার অক্ষরে— অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে। তখন থেকে অক্ষরের আকার ও গঠন প্রায় স্থায়িরূপে নির্ধারিত হল। তারপরে ছাপাখানার সুবিধের জন্য ধাতুতে ঢালাই অক্ষরের একটু-আধটু পরিবর্তন হলেও পুঁথির অক্ষর পরিবর্তনের মতো ছাপার অক্ষরের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি।
ভারতের সমস্ত লিপি-অক্ষরের আদিজননী ব্রাহ্মী লিপি। অশোকের অনুশাসনগুলি সুগঠিত ব্রাহ্মী অক্ষরেই উৎকীর্ণ হয়ে পর্বতগাত্রে কালজয়ী হয়ে এখনও বেঁচে আছে। ব্রাহ্মী অক্ষরের এই হল আদিম নিদর্শন। বিদেশি পণ্ডিতদের কেউ কেউ ব্রাহ্মী লিপির চমৎকার গঠনকৌশল দেখে মনে করেন, এগুলি বোধ হয় গ্রিক বা ফিনিশীয় লিপি থেকে এসেছে। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রাচীন ভারতীয়েরা ব্যাকরণ ও শব্দশাস্ত্রে যেরকম তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তাঁরা যে সেই ধ্বনিরূপকে রেখার আখরে বন্দি করতে চাইবেন, এতে আর বিস্ময়ের কি আছে? সে যাই হোক, এখন একপ্রকার স্থির সিদ্ধান্ত করা হয়েছে যে, প্রাচীন ভারতীয় ব্রাহ্মী লিপি এ-দেশের জল-বায়ুতে জন্মেছে, এ-দেশেই বিকাশ লাভ করেছে। ব্রাহ্মী লিপির বিবর্তনগত আকার দেখলে বোঝা যায়, ভারতের তাবৎ লিপির মূল রহস্য ব্রাহ্মী লিপিতেই নিহিত আছে : খ্রীস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর দিকে স্থানভেদে ব্রাহ্মী অক্ষর তিনটি রূপে বিবর্তিত হতে থাকে—পশ্চিমা লিপি, মধ্য-ভারতীয় লিপি ও পূর্বী লিপি। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চলিত ব্রাহ্মী অক্ষর থেকে পূর্ব-ভারতের তাবৎ লিপির জন্ম হয়েছে। অষ্টম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে পূর্ব-ভারতের লিপির নিজস্ব রূপ ফুটে ওঠে। অনেকের ধারণ নাগরী লিপি বুঝি বাংলা অক্ষরের চেয়ে পুরাতন। একথা কিন্তু ঠিক নয়। দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে পশ্চিমা ব্রাক্ষয়ী অক্ষর থেকে যে লিপির জন্ম হয় তার নাম নাগরী লিপি। এই নাগরী লিপি কোনো দিক থেকেই বাংলা অক্ষরের চেয়ে পুরাতন নয়। তবে উত্তরাপথের রাজবংশ পূর্ব-ভারতে দীর্ঘকাল আধিপতা করার ফলে এ-দেশের পূর্বী লিপি (অর্থাৎ বাংলা) রাজকীয় প্রভাবে কিছু কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল এবং রাজভাষা ও রাজলিপি বাংলাদেশে পঞ্চম সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করেছিল। অবশ্য কোনো দেশেই পরের লিপি দীর্ঘকাল দস্যুবৃত্তি করতে পারে না—পশ্চিমা নাগরী লিপিও পারেনি। খ্রী: দশম-একাদশ শতাব্দীর মধ্যে পশ্চিমা লিপির স্থলে বাংলার অক্ষর আবার নিজস্ব স্থান করে নিল। তারপর থেকে বাংলাদেশ এবং তার প্রান্তীয় অঞ্চলে লিপিলেখন ও পুঁথিপত্রে বঙ্গলিপিরই একচ্ছত্র অধিকার স্থাপিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে সংস্কৃত গ্রন্থেও বাংলা অক্ষর ব্যবহাত হত। সুতরাং আধুনিককালে বাংলাদেশের সংস্কৃত সমাজে যে নাগরী অক্ষরের প্রচলন আছে এবং যার প্রতি কোনো কোনো সংস্কৃত পণ্ডিতের ধর্মীয় শ্রদ্ধা ও আসক্তি আছে, তার কিছুমাত্র যৌক্তিকতা নেই। বাংলাদেশের সংস্কৃত গ্রন্থে বাংলা লিপি ব্যবহৃত হওয়া উচিত, ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে তাই-ই ছিল সাধারণ রীতি। দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লেখা সংস্কৃত গ্রন্থে (যথা— ১১শ-১২শ শতাব্দীর বজ্রবলী', ১৩শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে লিপিকৃত 'কালচক্রাবতার' এবং ঐ শতকের শেষভাগের পুঁথি 'হেবজ্রতন্ত্রটীকা') বাংলা অক্ষর অনেকটা পূর্ণতা লাভ করেছিল। সেনযুগে বাংলা অক্ষরের গঠনকার্য শুরু হয় এবং পাঠানযুগে তার মোটামুটি স্থায়ী আকার দাঁড়িয়ে যায়। মধ্যযুগের গোড়ার দিকের লিপির দৃষ্টান্ত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুথিতে খানিকটা পাওয়া যাবে। ওড়িয়া, মৈথিলি ও অসমিয়া লিপিতে বাংলা লিপির প্রভাব অনস্বীকার্য। মণিপুরে এখনও বাংলা লিপি পুরোপুরি ব্যবহৃত হয়। অসমিয়া ও বাংলা অক্ষরের মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই, দু' শতাব্দী পূর্বে অসমিয়া লিপি বলে কোনো পৃথক লিপিই ছিল না। ওড়িয়া লিপির গোলগাল মাত্রা ও চেহারা দেখে প্রথমে মনে হতে পারে—বুঝি এর সঙ্গে বাংলা অক্ষরের কোনো যোগ নেই। এক সময়ে ওড়িশার তালপাতার ওপর 'খোস্তা' নামক সূক্ষ্মাগ্র লৌহলেখনীর দ্বারা লিপিকার্য নির্বাহ হত। তাই সোজা রেখার বদলে গোলাকৃতি রেখা ব্যবহৃত হত, কারণ কোমল তালপাতার ওপর ধারালো খোত্তা দিয়ে সোজা বা কৌণিক রেখা টানতে গেলে তালপাতা ছিঁড়ে যেত। ওর মাত্রার গোলত্ব সোজা করে দিলেই ওড়িয়া লিপির সঙ্গে বাংলা লিপির আত্মীয়তার বন্ধন সহজেই চোখে পড়বে। মৈথিলি লিপিতেও যুগপৎ নাগরী ও বাংলা লিপির প্রভাব আছে। অবশ্য রাষ্ট্রবিধাতাদের কৃপায় মিথিলায় নাগরী লিপি চালানোর ফলে ইদানীং মৈথিল শিষ্টসমাজ থেকে বঙ্গলিপির প্রভাবাধীন মৈথিল লিপি প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে। বাংলাদেশ রাজনৈতিক কারণে দ্বিখণ্ডিত হয়েছে। পূর্ববাংলায় বাংলা ভাষার মহিমা অব্যাহত থাকলেও কূটচক্রী রাষ্ট্র-শাসকদের সংকেতে তাতে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে উর্দু-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। অবশ্য সম্প্রতি সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থেকে নিছক ধর্মীয় সংকীর্ণতা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ও-দেশে বাংলা অক্ষরের কোনো বদল হয়নি, যদিও ঢাকায় বাংলা বানান নিয়ে নানারকম সরলীকরণের গবেষণা চলছে। প্রায় দুই শতাব্দী আগে ছাপার অক্ষরে ব্যবহৃত হওয়ার পর বাংলা লিপির বিশেষ কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়নি।
(পশ্চিমবঙ্গের সাময়িক পত্রে, পুস্তকে লাইনো টাইপ চালানোর জন্য অনেক সময় যুক্তাক্ষর ভেঙে ছাপা হচ্ছে। এতে ছাপাখানার লোকদের অনেক সুবিধে হয়েছে, কিন্তু পাঠকসমাজ পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে।)


Shaharuk Islam

Hi I am Shaharuk Islam. I enjoyed in writing articles and spread knowledge cross over the internet.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

Ad

Magspot Blogger Template

Ad

amazon.in
amazon.in

نموذج الاتصال