প্রাচীন ভারতের ইতিহাস History of Ancient India in bengali

ভারতবর্ষের ইতিহাস : ভৌগোলিক পটভূমি

কোনো দেশের ভূগোল তথা ভৌগোলিক পরিবেশের সঙ্গে সেই দেশের ইতিহাসের যোগ অত্যন্ত নিবিড়। বস্তুত, ভূগোল ছাড়া ইতিহাস পাঠ অনেকটা ফ্রেম ছাড়া ছবির মতোই। এখানে আরো মনে রাখা দরকার যে-কোনো দেশ বা জাতির প্রকৃত ইতিহাস জানতে হলে সর্বাগ্রে সেই দেশের যথার্থ ভৌগোলিক পরিচয় সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর সমস্ত দেশের ন্যায় আমাদের দেশ ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। বহু যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষ ইতিহাসে এক মর্যাদাপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।

ভারতবর্ষের ভৌগোলিক পরিচয়

এখন আসা যাক ভারতবর্ষের নাম ও এর অবস্থান প্রসঙ্গে। ভারতবর্ষ তথা ভারত সম্পর্কিত নামের পরিচয় মেলে যীশুখ্রিস্টের জন্মের বহুকাল আগের লেখা বিদেশীয় (বিশেষত গ্রিক ও চীনাদের) এবং দেশীয় কিছু গ্রন্থ ও লেখমালায়। এ ব্যাপারে সবচেয়ে প্রাচীন যে নামটি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তা হল 'ইন্দোই’, যা পরবর্তীকালে 'ইন্দিয়া' এবং আরো পরে ইন্ডিয়া' নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রসঙ্গত বলা যায় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের শেষ বা পঞ্চম শতকের গোড়ার দিকের মানুষ ও মিলিতসের অধিবাসী হেকাটেয়াস তাঁর গ্রন্থে এবং খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের প্রখ্যাত গ্রিক পণ্ডিত হেরোডোটাস তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে ইন্দোই' শব্দের উল্লেখ করেছেন। এখানে স্মরণ রাখা দরকার যে হেরোডোটাস ‘ইন্দোই’ (ইন্ডিয়া)-কে পারস্যের আকিমিনীয় বংশের শাসক প্রথম দরায়ুসের (খ্রিস্টপূর্ব ৫২২-৪৮৬ অব্দ) শাসনাধীন একটি প্রদেশ হিসাবে উল্লেখ করেছেন, যা নিশ্চিতভাবে তখন সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে বোঝাত না—এই ‘ইন্দোই’-এর অবস্থান ছিল তখন সিন্ধুনদের ওপরে, যা বর্তমানকালের সিন্ধু প্রদেশের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে হয়। কিন্তু এর শতাধিক কাল পরে ‘ইন্দোই' বলতে বোঝাত আরো ব্যাপকতর এলাকাকে। উল্লেখ্য, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষ দিকে মৌর্য রাজদরবারে আগত গ্রিক দূত মেগাস্থিনিস তাঁর ইন্ডিকা গ্রন্থে পলিবোথরা (পাটলিপুত্র ও প্রাসিতায় (প্রাচ্যদেশ) এবং সুদূর দক্ষিণের পাণ্ড্য (পাণ্ডাইআ) দেশকেও ‘ইন্দোই' (ইন্দিয়া বা ইন্ডিয়া)-এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। প্রায় অনুরূপ তথ্য প্রদান করেছেন। সমসাময়িক গ্রিক লেখক এরাটোসথেনিসও। অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে এই পর্বের গ্রিক লেখকরা ইন্দোই বা ইন্দিয়া বলতে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে বুঝিয়েছেন।
বিদেশীয় লেখ ও গ্রন্থাদিতে ভারতবর্ষ প্রসঙ্গে ইন্দোই' ছাড়াও ‘'হিন্দু' বা 'সিন্ধু” নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। পারস্যের আকিমেনীয় শাসক প্রথম দরায়ুসের নক্শ-ই- রুস্তম লেখতে তাঁর শাসনাধীন প্রদেশ হিসাবে হিন্দু (সিন্ধু)-র নাম আছে, যার তখন অবস্থান ছিল সিন্ধু নদের ওপরে (বর্তমান সিন্ধু প্রদেশ)। প্রসঙ্গত বলা যায় কয়েকটি পারসিক ও আরবীয় গ্রন্থে 'হিন্দুস্তান'-এর উল্লেখ আছে। 'হিন্দুস্তান' বলতে প্রথম দিকে নিম্ন সিন্ধ অঞ্চলকে বোঝানো হত বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। অবশ্য ধীরে ধীরে নামটি সমগ্র উপমহাদেশের অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকে। প্রসঙ্গত বলা যায় বিতস্তা (ঝিলাম), বিপাশা, শতদ্রু ইরাবতী (রাভি) ও চেনাব সিন্ধুনদের এই পঞ্চশাখাকে বলা হত পঞ্চসিন্ধু। এর সঙ্গে গঙ্গা ও যমুনাকে যুক্ত করে বলা হত সপ্তসিন্ধু অঞ্চল, যা সমকালীন বিদেশীয়দের মুগ্ধ করেছিল। এইভাবেই উদ্ভব হয় 'হিন্দু' নামের। ফ্যান- ই-র লেখা চীনা গ্রন্থ হৌ হান-ও তেওঁ উল্লেখিত 'সেন-তু' ও 'তিয়েন চু' অর্থে প্রথম দিকে নিম্ন সিন্ধু অঞ্চলকে বোঝানো হত। তবে পরের দিকে বিশেষ করে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের গোড়ার দিক থেকে চীনা নাম দুটির ভৌগোলিক সীমানাভুক্ত হয়েছিল খুব সম্ভবত সমগ্র উপমহাদেশ।
বর্তমান কালের ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সামগ্রিক ভূখণ্ডই হল ভারতীয় উপমহাদেশ অর্থাৎ অবিভক্ত ভারতবর্ষ। মৌর্য আমলে সমগ্র ভারত উপমহাদেশ খুব সম্ভবত পরিচিত ছিল জম্বুদ্বীপ নামে। প্রসঙ্গত বলা যায় মৌর্য সম্রাট অশোকের প্রথম ক্ষুদ্র (অপ্রধান) শিলালেখতে তাঁর অধিকৃত সুবিশাল সাম্রাজ্য জম্বুদ্বীপ' নামে উল্লেখিত হয়েছে।" এখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় হবে যে ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্য পুরাণ (বিশেষত অগ্নি, মৎস্য ও পদ্ম)-এও ভারতবর্ষ অর্থে জম্বুদ্বীপের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। আবার মহাভারত (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ খ্রিস্টীয় ৪০০ অব্দ)-এর এক জায়গায় জম্বুদ্বীপ চারটি মহাদেশ সূচক দ্বীপের একটি এবং এর একটি বর্ষ বা অংশের নাম ভারতবর্ষ বলে অভিহিত হয়েছে। এছাড়া খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে উৎকীর্ণ কলিঙ্গরাজ খারবেলের হাথিগুম্ফা লেখতে 'ভরধবর্ষ' (ভারতবর্ষ)-র উল্লেখ আছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে সুপ্রাচীনকাল থেকেই দেশীয় ও বিদেশীয় গ্রন্থে ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থে বিভিন্ন নামের ব্যবহার এই উপমহাদেশের জাতিগত ঐক্যের ইঙ্গিত দেয়।
এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে একটি ত্রিভুজাকৃতি উপদ্বীপের অংশ হিসাবে ভারতবর্ষ বিরাজমান। এই মহাদেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাশীল স্থান দখল করে আছে এই উপদ্বীপটি। বিষ্ণুপুরাণে ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান বর্ণিত হয়েছে এইভাবেঃ
উত্তরং যৎ সমুদ্রস্য হিমাদ্রেশ্চৈব দক্ষিণম্।
বর্ষং তম্ভারতং নাম ভারতী যত্র সস্তুতিঃ।।

এই শ্লোকটির মূল অর্থ হল সমুদ্রের উত্তরে এবং হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত যে দেশ, তার নাম ভারত। বস্তুত, ভারতবর্ষ চারদিকেই বেষ্টিত রয়েছে প্রাকৃতিক সীমারেখা দ্বারা। এর পূর্বদিকে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে আরবসাগর এবং দক্ষিণে ভারত মহাসাগর বিদ্যমান। এছাড়া উত্তরে সুউচ্চ হিমালয় পর্বত ভারতবর্ষকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপদ রেখেছে। এইভাবে পৃথিবীর অন্যান্য অংশ থেকে ভারতবর্ষ ভৌগোলিক দিক থেকে পৃথক। আয়তনের দিক থেকে ভারতবর্ষ একটি বিশাল দেশ। বিশাল আয়তনের দরুন এটি ভারতীয় উপমহাদেশ নামেই সমধিক পরিচিত। সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় যে, ভারতের ভৌগোলিক সীমানা পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রায় ২,৫০০ মাইল এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে ২,০০০ মাইল বিস্তৃত। মোট এলাকার আয়তন ১,৮০০,০০০ বর্গ মাইল। পৃথিবীর মধ্যে আয়তনের দিক থেকে ভারত সপ্তম স্থানের অধিকারী। রাশিয়াকে বাদ দিলে ইওরোপের বাকি অংশ অথবা গ্রেট ব্রিটেনের কুড়িগুণ করলে যে আয়তন দাঁড়ায় তা সমান হল অবিভক্ত ভারতবর্ষের আয়তন।
ভারতবর্ষের ইতিহাস : ভৌগোলিক পটভূমি
ভারতবর্ষের ইতিহাস : ভৌগোলিক পটভূমি

ভারতের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য

ভারতবর্ষে সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বর্তমান। ভূপ্রকৃতিগত দিক থেকে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে প্রধান পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এগুলি হল :
১. হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল ;
২. উত্তর ভারতের বিস্তৃত সমভূমি অঞ্চল ;
৩. উপদ্বীপ অঞ্চল, যা আবার মধ্যভারতের উচ্চভূমি এবং উপদ্বীপীয় মালভূমি
—এই দুটি ভাগে বিভক্ত।
৪. উপকূলবর্তী নিম্নভূমি এবং
৫. প্রান্তদেশীয় সাগর ও দ্বীপসমূহ।

■ ভারতীয় ইতিহাসে ভৌগোলিক উপাদান ও তার প্রভাব (Geographical factors and their impact on Indian History) :

• ভৌগোলিক উপাদান : ভারতবর্ষ একটি বিশাল উপমহাদেশ। এটি রাশিয়াকে বাদ দিয়ে সমগ্র ইউরোপের সমান এবং পৃথিবীর মধ্যে আয়তনের দিক থেকে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। এই উপমহাদেশের পশ্চিমে আরব সাগর, পূর্বে বঙ্গোপসাগর ও দক্ষিণে ভারত মহাসাগর অবস্থান করায় এটি উপদ্বীপীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। এশিয়ার বৃহত্তম উপমহাদেশ এই ভারতবর্ষকে ভূপ্রকৃতির বৈচিত্র্য অনুসারে 'আর্যাবর্ত' ও 'দাক্ষিণাত্য’- এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একইভাবে 'আর্যাবর্তী'কে আবার প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে : যেমন – (১) উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল, (২) সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বিধৌত সমভূমি অঞ্চল ও (৩) মধ্য ভারতের মালভূমি অঞ্চল। আর ভারতের প্রাকৃতিক দাক্ষিণাত্যের দুটি প্রাকৃতিক বিভাগ হল— (১) দক্ষিণ ভারতের বিভাগ মালভূমি এবং (২) সুদূর দক্ষিণের উপদ্বীপ ও উপকূল অঞ্চল। এইভাবে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে ভারতবর্ষ পাঁচটি প্রধান ভাগে বিভক্ত হয়েছে। পুরাণ-এর 'ভুবনকোষে ভারতবর্ষের ন'টি বিভাগের উল্লেখ রয়েছে। এই বিভাগগুলো । হল— কশেরুমান, কুমার (কুমারী), ইন্দ্রদ্বীপ, নাগদ্বীপ, সৌম্য, গান্ধর্ব, গভস্তিমান, বারুণ এবং তাম্রবর্ণ। তবে এই বিভাজন অপেক্ষা প্রথমোক্ত পাঁচটি বিভাগকে বর্তমানে অধিকাংশ ঐতিহাসিক গ্রহণ করেছেন। ঐতিহাসিক ভি. এ. স্মিথ মালভূমির দক্ষিণে মাদ্রাজ, কেরল, কোচিন, ত্রিবাঙ্কুর ইত্যাদি নিয়ে গঠিত ভাগকে “সুদূর দক্ষিণ" (Far— South) বলে চিহ্নিত করেছেন। 
• ভৌগোলিক প্রভাব : কোনো দেশের ইতিহাস সেই দেশের ভৌগোলিক পরিবেশের মধ্যে গড়ে ওঠে। মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনে এই ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক প্রভাব এক চিরন্তন সত্য ঘটনা। ভারতের সভ্যতা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, জীবনযাত্রার প্রণালী ও জীবনদর্শন সবটাই ভৌগোলিক পরিবেশের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। ফরাসি পণ্ডিত জন বোদিন (Bodin) যথার্থই বলেছিলেন, “প্রকৃতির সন্তান মানুষের জাতীয় চরিত্র গঠনে, কোনো অঞ্চলের ভৌগোলিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী।" আবার আন্তর্জাতিক ঐতিহাসিক টয়েনবির (Toynbee) কথায় ইতিহাসের নায়ক মানুষ ভৌগোলিক উপাদানকে যেভাবে ব্যবহার করে, সেভাবেই সবকিছু নির্ধারিত হয় ("Geographical facts are the only fact as approached by man")।
* মানব সভ্যতার উত্থানে ভৌগোলিক প্রভাব ইতিহাসের সাথে এক অনিবার্য বন্ধনে আবদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, নীলনদ না থাকলে মিশর সাহারা মরুভূমির গর্ভে হারিয়ে যেত। প্রাচীন গ্রিস ইজিয়ান সাগর ও ভূমধ্যসাগর পরিবৃত হওয়ায় গ্রিসের অধিবাসীরা বাণিজ্য  ও নৌবিদ্যায় এত পারদর্শী। আবার অধ্যাপক জে. বি. বিউরি-র মতে, পর্বতসংকুল হওয়ায় প্রাচীন গ্রিসে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রের পরিবর্তে অসংখ্য ছোটো ‘পলিশ” বা “নগর-রাষ্ট্র” (City-State) গড়ে ওঠে। অখণ্ড গণতান্ত্রিক চেতনার পরিবর্তে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার (Self-control) জাগ্রত করতে সাহায্য করেছে। আবার ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও আয়ারল্যান্ডকে নিয়ে গঠিত ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ অনুকূল ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য এত উন্নত। এই দ্বীপপুঞ্জের চেয়ে আয়তনে প্রায় কুড়িগুণ বড়ো হল ভারতবর্ষ।
*হিমালয়ের প্রভাব  ভারতের ইতিহাস ও সভ্যতার উপর হিমালয়ের আশীর্বাদ অপরিমেয়। ঐতিহাসিক * কে. এম. পানিক্কর ('A Survey of Indian History' গ্রন্থে) বলেছেন, মিশরকে যদি “নীলনদের দান” বলা হয়, তবে ভারতবর্ষকে “হিমালয়ের দান" বলে উল্লেখ করলে কোনো অত্যুক্তি হবে না। তার কারণ হিমালয় ভারতকে বহুভাবে সমৃদ্ধ করেছে। আবার অন্যদিকে হিমালয়ের বরফগলা জলে পুষ্ট নদীগুলো ভারতকে সুজলা- সুফলা-শস্য-শ্যামলা দেশে পরিণত করেছে। তবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে বিভিন্ন গিরিপথ যেমন- খাইবার, বোলান, বানিহাল, গোমাল, কারাকোরাম, পিরপক্কাল প্রভৃতি বহির্ভারতের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছে। 
* বিন্ধ্য  পর্বতের জন্য উত্তরে আর্যাবর্তের সঙ্গে দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের মধ্যভাগে অবস্থিত হওয়ার ফলে উত্তর ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের একটা স্বাভাবিক ব্যবধান ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল। কিংবদন্তি আছে অগস্ত্য মুনি বিশ্বা পর্বত অতিক্রম করতে গিয়ে আর ফেরেননি। সেই জন্য বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে অজ্ঞাত স্থানে যাত্রাকে বলা হত অগস্ত্যযাত্রা বা শেষযাত্রা। তবে ভারতের ইতিহাসে এই পর্বতের সবচেয়ে বড়ো প্রভাব হল, দক্ষিণে 'দ্রাবিড় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে এবং সৃষ্টি হয়েছে উন্নত ও মৌলিক শিল্প স্থাপত্য। বিদ্ধ্য পর্বত অতিক্রম করে প্রথমে আর্যরা এসেছিল দক্ষিণে। তারপর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক, সমুদ্রগুপ্ত, আলাউদ্দিন খলজি, আকবর প্রমুখ বিন্ধ্য পর্বত অতিক্রম করে দক্ষিণ ভারতে এলেও দ্রাবিড় সভ্যতায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থেকেই গেছে।
* ভারতের পূর্বে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর ও দক্ষিণে ভারত মহাসাগর অবস্থিত হওয়ায় প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধা হয়েছে। কারণ দুর্গম ও দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে কোনো জলদস্যুর আক্রমণ তেমনভাবে ঘটেনি। ড. রোমিলা থাপারের মতে, সমুদ্রসংলগ্ন হওয়ায় দক্ষিণ ভারতের চোলরা সামুদ্রিক কার্যাবলিতে বিশেষত  নৌবিদ্যা ও বাণিজ্যে এত বেশি পারদর্শী। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-ডা-গামা দক্ষিণ ভারতের কালিকট বন্দরে এসে উপনীত হলেও তিনি লুণ্ঠন করতে আসেননি। বরং তাঁর আগমনের পর জলপথ আবিষ্কার হওয়ায় ভারত শিল্প-বাণিজ্যের দিক দিয়ে বহির্বিশ্বের সান্নিধ্য লাভ করে। তারপর একে-একে পোর্তুগিজ, ওলন্দাজ, দিনেমার, ফরাসি, ইংরেজ প্রভৃতি বণিকরাই জলপথে ভারতে এসেছিলেন।
* উত্তর ভারতের সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বিধৌত সমভূমির মধ্যে গাঙ্গেয় সমভূমিকে "ভারতের হৃৎপিণ্ড" বলা যেতে পারে। এই গাঙ্গেয় সমভূমির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩,০০০ কিমি. সমভূমি ও নদনদীর এবং প্রস্থ ২৫০-৩০০ কিমি.। অনুকূল অনুপম এই সমভূমি অঞ্চলে, প্রভাব বিশেষত গঙ্গার তীর ধরে প্রাচীনকাল থেকে যে শহর, নগর, বন্দর, সাম্রাজ্য, ধর্মক্ষেত্র ইত্যাদি গড়ে ওঠে, তার উপর ভিত্তি করে ভারতীয় সভ্যতার জৌলুস বেড়েছে। ভারতমাতার সারা শরীরে অসংখ্য শিরা-উপশিরার মতো যেসব নদী রয়েছে ভারতের সামগ্রিক জীবনযাত্রায় তারও প্রভাব বর্ণনাতীত।
* ভারতের দক্ষিণে পূর্ব উপকূল ও পশ্চিম উপকূল মিলিয়ে মোট ৪৮২৭ কিমি.  দীর্ঘ উপকূলরেখা রয়েছে। ভারতের পশ্চিম উপকূলে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা খাড়াভাবে দণ্ডায়মান থাকায় পূর্বঘাট পর্বতসংলগ্ন পূর্ব উপকূল অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন  

Shaharuk Islam

Hi I am Shaharuk Islam. I enjoyed in writing articles and spread knowledge cross over the internet.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

Ad

Magspot Blogger Template

Ad

amazon.in
amazon.in

نموذج الاتصال