মাছ চাষে ব্যবহৃত আধুনিক হ্যাচারি
(Modern hatcheries used in fish farming)
আধুনিক হ্যাচারিগুলির মধ্যে (1) গ্লাস জার হ্যাচারি (Glass jar hatchery), (2) চাইনিজ হ্যাচারি (Chinese hatchery) বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এগুলি ছাড়াও আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টায় নানবিধ হ্যাচারির উদ্ভাবন করা হয়েছে। যেমন-(i) হ্যাচিং জার (Hatching jar)-এটি প্লাস্টিক, কাচ বা মাটির জারের সঙ্গে জলের প্রবেশ এবং নির্গমনের নল যুক্ত করে ডিম ফোটানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। (ii) পরিবহণযোগ্য হ্যাচারি (Portable hatcheries)-ডিমকে ফোটানোর জন্য পরিবহণযোগ্য হ্যাচারির
p মধ্যে অমিতাভ মডেল হ্যাচারি (Amitava model hatchery) এবং দ্বিবেদী হ্যাচারি (Dwivedi hatchery) জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অমিতাভ মডেলটি গ্যালভানাইজড লোহার পাত দিয়ে তৈরি গোলাকার ও লম্বাটে আকৃতি প্রকোষ্ঠ। এর মধ্যে আর একটি প্রকোষ্ঠ বসানো থাকে যেটি নাইলনের জাল দ্বারা ঘেরা থাকে। অন্যদিকে দ্বিবেদী হ্যাচারি সিনটেক্স ট্যাঙ্ক নির্মিত এবং এর ভিতরে 6, 12 অথবা 24টি জারে ডিম ফোটানোর ব্যবস্থা থাকে। উভয় প্রকার হ্যাচারির মধ্যে জলের প্রবেশ, চক্রাকারে জলের ঘূর্ণন এবং জলের নির্গমনের ব্যবস্থা থাকে।
1. গ্লাস জার হ্যাচারি (Glass jar hatchery)ĺ বর্তমানে হ্যাচিং হাপার পরিবর্তে ওপরে চিত্রায়িত গ্রাস জার হ্যাচারির মাধ্যমে নিষিক্ত ডিম থেকে ডিমপোনার উৎপাদন করা হচ্ছে। এখানে ব্যবহৃত জারগুলি কাচের হওয়ার নিষিক্ত ডিমের পরিস্ফুরণ পর্যবেক্ষণ করা যায় এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তাছাড়া স্বল্প স্থানের মধ্যে অধিক পরিমাণে ডিমপোনা উৎপাদন সম্ভব। অবশেষে সংগৃহীত ডিমপোনা আঁতুড় পুকুরে (Nursery pond) স্থানান্তরিত করা হয়।
2. চাইনিজ হ্যাচারি (Chinese hatchery or Ecohatchery) :ভারতবর্ষে প্রচলিত আধুনিক মানের হ্যাচারিগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনসমাদৃত হয়েছে চাইনিজ হ্যাচারি। চিনদেশে বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে এই প্রকার হ্যাচারির উদ্ভাবন করা হয়। ভারতবর্ষে কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন ও ডিমফোটানোর জন্য চাইনিজ হ্যাচারির প্রবর্তন হয় বিগত শতাব্দীর আশির দশকে। সিমেন্ট বা কংক্রিটে তৈরি বড়ো জলাধারের মাধ্যমে দেশজ কার্প (রুই, কাতলা, মৃগেল প্রভৃতি) এবং বিদেশাগত কার্পের (সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, সাইপ্রিনাস কার্প প্রভৃতি) প্রজনন ও নিষিক্ত ডিমের প্রস্ফুটন অকল্পনীয় সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করা হচ্ছে। চাইনিজ হ্যাচারির অপর নাম ইকোহ্যাচারি (Ecohatchery) কারণ মাছের প্রজননের প্রাকৃতিক শর্তগুলি অর্থাৎ বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশ যতদূর সম্ভব বজায় রেখে কার্পের হ্যাচিং করানো হয়ে থাকে। আদর্শ চাইনিজ হ্যাচারির বিভিন্ন অংশগুলি হল-
1. একটি রিজার্ভার জলধার (Reservoir tank),
2. একটি বৃহৎ আকারের ওভারহেড ট্যাঙ্ক (Overhead tank),
3. একটি প্রজনন বা স্পনিং জলাধার (Spawning tank),
4. দুইটি বৃত্তাকার ডিম ফোটানোর বা হ্যাচিং জলাধার (Circular hatching tank),
5. এই ডিমপোনা বা স্পন সংগ্রহকারী প্রকোষ্ঠ (Spawn collection chamber) |
1. মাটির তৈরি ছোটো পুকুর (100 ফুট × 25 ফুট × 8-10) যেখানে ভূনিম্নস্থ জল প্রায় 400 ফুট গভীরতা থেকে মোটর পাম্পের সাহায্যে তুলে রাখা হয় কয়েক ঘণ্টার জন্য। এর ফলে জলের তাপমাত্রা, অক্সিজেনের ঘনত্ব, pH ইত্যাদি প্রাকৃতিক পুকুরের পর্যায়ে চলে আসে। এরপর পাম্পের সাহায্যে ওই জল পাঠানো হয় ওভারহেড ট্যাঙ্কে। এটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
2. সিমেন্ট বা কংক্রিটের তৈরি একটি বড়ো ওভারহেড ট্যাঙ্ক ভূমি থেকে বেশ উঁচুতে স্থাপন করা হয়। প্রায় 50,000 লিটার জল ধরে এমন ট্যাঙ্কটিতে পাইপের সাহায্যে জলের প্রবেশ ও নির্গমনের ব্যবস্থা থাকে। নল ও ফোয়ারার মাধ্যমে জল ওই ট্যাঙ্ক থেকে প্রজনন জলাধারে প্রবেশ করানো হয়।
3. প্রজনন বা স্পনিং জলাধারটিও কংক্রিট নির্মিত। এটি গোলাকার বা চৌকো আকৃতির হতে পারে এবং এর গভীরতা 1-1.5 মিটার হয়। এই ট্যাঙ্কে জল ধারণ ক্ষমতা প্রায় 50 কিউবিক মিটার। কার্পদের স্বাভাবিক প্রজনন-অনুকূল পরিবেশ ও উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য জলের নল ও ফোয়ারার সাহায্যে ট্যাঙ্কের অভ্যন্তরে অবিরাম জলস্রোত সৃষ্টির ব্যবস্থা করা থাকে। প্রজনন বা স্পনিং-এর পর নিষিক্ত ডিমগুলি ট্যাঙ্কের তলদেশের ঢালু কেন্দ্র স্থলে জমা হয়। পরে নির্গমন নলের মাধ্যমে হ্যাচিং জলাধারে পাঠানো হয়।
4. হ্যাচিং জলাধার দুই বা তার অধিক থাকে, আকারে গোলাকার এবং কংক্রিটের হয়। প্রতিটি জলাধার 3-4 মিটার ব্যাসযুক্ত এবং গভীরতা প্রায় ।(one) মিটার। এই জলাধারের কেন্দ্রে একটি মোটা নির্গমন নল খাড়াভাবে বসানো থাকে এবং একে ঘিরে । মিটার ব্যাস বিশিষ্ট একটি অভ্যন্তরীণ প্রকোষ্ঠ থাকে। এই প্রকোষ্ঠটি আগোগোড়া নাইলনের জাল দ্বারা ঘেরা থাকে। নিষিক্ত ডিমের ইনকিউবেশন (incubation) বা হ্যাচিং-এর জন্য অবিরাম জল প্রবাহ আবশ্যক, তাই এই জলাধারাটির বাহিরের প্রকোষ্ঠের অভ্যন্তরে ও পাশের দেওয়ালে অনেকগুলি তির্যকভাবে অবস্থিত জলের নল দ্বারা চক্রাকারে নিরবিচ্ছিন্ন জলস্রোত সৃষ্টির ব্যবস্থা করা থাকে। মূল জলাধারে নিষিক্ত ডিমের সংখ্যার পরিমাণ অধিক হলে এর সঙ্গে অনুরূপ গঠন বিশিষ্ট একাধিক হ্যাচিং জলাধার ভালবের সাহায্যে যুক্ত করা হয়, যাতে অক্সিজেনের ঘাটতি না দেখা দেয়। নিষিক্ত ডিম ফুটে ডিমপোনা (spawn) নির্গত হয়। সাধারণত তিনদিন পর ভিতরের প্রকোষ্ঠের জালের আবরণ সরিয়ে ফেলা হয়। এর ফলে পরিস্ফুটিত ডিমপোনাগুলি নির্গমন নলের
মাধ্যমে স্পন সংগ্রাহক প্রকোষ্ঠে চলে আসে।5. ডিমপোনা সংগ্রহকারী প্রকোষ্ঠটি আয়তাকার এবং সিমেন্ট নির্মিত। এটি সাধারণত দৈর্ঘ্যে 10 মিটার, প্রস্থে 6 মিটার এবং গভীরতায় 1.5 মিটার হয়। পরিশেষে ওই জলাধার থেকে সূক্ষ্ম, মসৃণ হাত জাল দিয়ে ডিমপোনা সংগ্রহ করা হয় ও তাদেরকে প্রতিপালনের জন্য আঁতুড় পুকুরে (Nursery pond) পাঠানো হয়।