history of india pdf

■ মৌর্য সাম্রাজ্য ■

নন্দবংশ উচ্ছেদ করে মগধের ইতিহাসে মৌর্য বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। মৌর্য শাসন ভারত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে। ভারতজোড়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা, সুশাসন প্রবর্তন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও শিল্প-সংস্কৃতির উন্নতি— সবদিকেই এই যুগে এক অভাবনীয় উন্নতি পরিলক্ষিত হয়।

এই যুগ থেকে ইতিহাসের প্রচুর উপাদান পাওয়া যায়। এই যুগের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে মেগাস্থিনিস, প্লিনি, অ্যারিয়ান ও জাস্টিনের রচনা, কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র', ইতিহাসের উপাদান বিশাখদত্তের 'মুদ্রারাক্ষস', সোমদেব ভট্টের 'কথাসরিৎসাগর', ক্ষেমেন্দ্রের 'বৃহৎকথামঞ্জরী' প্রভৃতি সংস্কৃত গ্রন্থ, বিভিন্ন পুরাণ, বৌদ্ধ ও জৈন শাস্ত্রগ্রন্থ এবং সম্রাট অশোকের বিভিন্ন গুম্ভলিপি ও শিলালিপি অতি উল্লেখযোগ্য।


→ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (৩২৪-৩০০ খ্রিঃ পূঃ) ঃ মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বংশপরিচয় সম্পর্কে নানা মত প্রচলিত আছে। পুরাণ-এর মতে তিনি শূদ্রগর্ভোদ্ভব বংশপরিচয় ছিলেন। তাঁর মাতা অথবা মাতামহী মুরা ছিলেন নন্দবংশীয় এক রাজার শূদ্রপত্নী। মুরার নাম থেকে এই বংশ মৌর্যবংশ নামে পরিচিত। বৌদ্ধগ্রন্থ অনুসারে তিনি হিমালয়ের পাদদেশে পিপ্পলিবন নামক স্থানের ‘মোরিয়' নামে এক প্রজাতান্ত্রিক ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীর সন্তান। 'মোরিয়’ নাম থেকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ মৌর্যবংশ নামে পরিচিত হয়েছে। বিভিন্ন জৈনগ্রহ, পালি সাহিত্য ও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে চন্দ্রগুপ্তকে অভিজাত ও ক্ষত্রিয়রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। আধুনিক ঐতিহাসিকরাও তাঁকে ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত বলেই মনে করেন।
বৌদ্ধগ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, চন্দ্রগুপ্তের পিতা যুদ্ধে নিহত হলে তাঁর মা শিশু চন্দ্রগুপ্তকে নিয়ে মগধের রাজধানী পাটলিপুত্রে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে শিকারী ও বাল্যকাল রাখাল বালকদের মধ্যে তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হতে থাকে। কথিত আছে যে, এ সময় চাণক্য নামে নন্দ শাসন-বিদ্বেষী জনৈক বিচক্ষণ ব্রাহ্মণ তাঁর মধ্যে নানা রাজোচিত লক্ষণ ও গুণাবলী লক্ষ্য করে তাঁকে তক্ষশিলায় নিয়ে যান এবং রাজনীতি ও যুদ্ধবিদ্যায় সুশিক্ষিত করে তোলেন। বলা বাহুল্য, এই চাণক্যই হলেন ইতিহাসখ্যাত বিশিষ্ট কূটনীতিজ্ঞ কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্ত। ৩২৬-২৫ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত ইতিহাসের পাদপ্রদীপের সামনে এসে হাজির হন।
আলেকজান্ডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ গ্রিক ঐতিহাসিক জাস্টিন ও প্লুটার্ক-এর রচনা থেকে জানা যায় যে, গ্রিকবীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণকালে তরুণ চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নন্দবংশের উচ্ছেদের জন্য তার সাহায্য প্রার্থনা করেন। আলেকজান্ডার তাঁর নির্ভীক আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেন, কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত পলায়নে সক্ষম হন। অতঃপর বিন্ধ্যের অরণ্য-সংকুল অঞ্চলে বসবাসকারী উপজাতিদের নিয়ে তিনি একটি সেনাদল গঠন করেন এবং চাণক্যের সাহায্যে মগধের সিংহাসন দখল করেন (৩২৪ খ্রিঃ পূঃ)। মগধ সাম্রাজ্য জয় মগধ সাম্রাজ্য বলতে তখন পাঞ্জাবের সীমানা থেকে দক্ষিণে গোদাবরী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগকে বোঝাত। 
এরপর চন্দ্রগুপ্ত উত্তর-পশ্চিম ভারতে গ্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর গ্রিক-অধিকৃত ভারতবর্ষে বিদ্রোহ শুরু হয়। এছাড়া, উত্তরাধিকারীহীন আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যের বণ্টন নিয়েও তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়। এর ফলে ভারতে গ্রিকশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য গ্রিকদের ওপর আক্রমণ হানেন। গ্রিক ঐতিহাসিক জাস্টিন লিখছেন যে, “আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ভারতীয়রা গ্রিক শাসকদের হত্যা করে দাসত্ব মুক্ত হয়। এই মুক্তিযুদ্ধের নায়ক ছিলেন সান্ড্রোকোট্টাস বা চন্দ্রগুপ্ত।” এইভাবে তিনি সিন্ধুপ্রদেশ ও পাঞ্জাব জয় করে উত্তর-পশ্চিম ভারতে আলেকজান্ডার প্রতিষ্ঠিত গ্রিক উপনিবেশগুলি অধিকার করেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে বিভক্ত হয়। সিরিয়া ও ভারতবর্ষ সেনাপতি সেলুকাস-এর ভাগে পড়ে। এই অংশগুলি পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে তিনি ভারতবর্ষ আক্রমণ করলে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয় (৩০০ খ্রিঃ পূঃ)। এই যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে গ্রিক ঐতিহাসিকরা স্পষ্ট করে কিছু না বললেও মনে হয় সেলুকাস এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শেষ পর্যন্ত এক সন্ধি স্বাক্ষর করেন। সন্ধির শর্ত অনুসারে তিনি কাবুল, কান্দাহার, হিরাট ও বেলুচিস্তান-এর অন্তর্গত মাকরাণ প্রদেশ চন্দ্রগুপ্তকে অর্পণ করেন এবং কথিত আছে যে, তাঁর কন্যা হেলেন-এর সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের বিবাহ দেন। সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় যেগাস্থিনিস নামে একজন গ্রিক দূতকে পাঠান। ‘ইন্ডিকা' নামে মেগাস্থিনিসের ভারত বিবরণ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কেবলমাত্র এই নয়—গ্রিক ঐতিহাসিক প্লুটার্ক-এর মতে, তিনি ছয় লক্ষ সেনা নিয়ে | ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। শকরাজা রুদ্রদামনের জুনাগড় শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি পশ্চিম ভারতে সৌরাষ্ট্র বা জয় করেন। নন্দদের উত্তরাধিকারী হিসেবে দাক্ষিণাত্যে গোদাবরী পর্যন্ত রাজ্যাংশ তিনি। গুজরাট জয় করেন। মালব ও কোঙ্কন বা মহারাষ্ট্রের কিছু অংশ তিনি এমনিতেই লাভ করেন এবং পরবর্তীকালে তিনি তা আরও সম্প্রসারিত করেন। দাক্ষিণাত্যে | মহীশূরের চিতলদ্রুগ জেলা ও তামিলনাড়ুর তিনেভেলি জেলা পর্যন্ত তাঁর আধিপত্য বিস্তৃত ছিল। পূর্ব ভারতে বাংলা বা বঙ্গদেশও তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত | বান্ধলিপি ও হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর সাম্রাজ্য উত্তর পূর্বে পারস্য সাম্রাজ্যের সীমানা, পশ্চিমে আরব সাগর, পূর্বে বাংলা এবং দক্ষিণে মহীশুর আয়তন ও মাদ্রাজ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ইতিপূর্বে আর কোন ভারতীয় নরপতির পক্ষে এত বড় সাম্রাজ্য স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। ঐতিহাসিক উঃ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী তাকে “ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক বৃহৎ সাম্রাজ্যের স্থাপয়িতা First historical founder of a great empire in India') বলে অভিহিত করেছেন। ছিলেন। একজন ভাগ্যান্বেষী হিসেবে জীবন শুরু করে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তিনি মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এক অনন্যসাধারণ কীর্তির অধিকারী ।
এক বৃহৎ ও সার্বভৌম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। শক্তিশালী নন্দবংশের ধ্বংসসাধন ও বিদেশি গ্রিক শক্তির উচ্ছেদ তাঁর সামরিক কৃতিত্বের পরিচয় বহন করে। যুগ যুগ ধরে ভারতীয় রাজন্যবর্গ যে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন, তিনি তা বহুলাংশে কৃতিত্ব বাস্তবায়িত্ব করেন। কেবলমাত্র সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাই নয়—বিজিত অঞ্চলে তিনি একটি সুষ্ঠু, কেন্দ্রীভূত ও প্রজাহিতৈষী শাসনব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠিত করেন। শেষজীবনে তিনি জৈনধর্ম গ্রহণ করেন এবং জৈনপ্রথা অনুসারে মহীশূরের শ্রবণবেলগোলা নামক স্থানে অনশনে দেহত্যাগ করেন (খ্রিঃ পূঃ ৩০০ অব্দ)।

Shaharuk Islam

Hi I am Shaharuk Islam. I enjoyed in writing articles and spread knowledge cross over the internet.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

Ad

Magspot Blogger Template

Ad

amazon.in
amazon.in

نموذج الاتصال