ভক্তিবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রিঃ)। তিনি নবদ্বীপের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং বাল্যেই ব্যাকরণ, ন্যায়, দর্শন প্রভৃতি নানা শাস্ত্রে গভীর ব্যুৎপত্তি লাভ করে অসাধারণ পণ্ডিত বলে খ্যাতি অর্জন করেন।বাইশ বছর বয়সে তিনি বৈষ্ণব গুরু ঈশ্বরপুরি-র কাছে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা লাভ করেন।
চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করে তিনি বৈষ্ণব ধর্মের মূলমন্ত্র বৈরাগ্য, বিশুদ্ধ প্রেম, ভক্তি ও জীবে দয়ার আদর্শ প্রচারে ব্রতী হন। তাঁর অনুগামীদের তিনি তৃণের মত নম্র ও নিরহঙ্কারী হওয়ার উপদেশ দিতেন। তিনি বলেন যে, ভক্তি ছাড়া জীবের মুক্তি নেই। বাংলাদেশে প্রেম ও ভক্তিমূলক বৈষ্ণবধর্ম প্রচারে তিনি ছিলেন সর্বাগ্রগণ্য।
তিনি জাতিভেদ ও ব্রাহ্মণের প্রাধান্য অস্বীকার করে সমগ্র মানব সমাজের জন্য প্রেমধর্ম প্রচার করেন। তিনি মনে করতেন যে, সকল মানুষই সমান আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী এবং ভক্তিভাবের মাধ্যমে মুক্তিলাভ সম্ভব। উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ করে সর্বত্র তিনি প্রেমধর্মের বন্যা প্রবাহিত করেন। জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। তাঁর অগণিত শিষ্যের মধ্যে উড়িষ্যা-রাজ প্রতাপরুদ্রদেব, নিত্যানন্দ, শ্রীবাস, জীবগোস্বামী, রূপ-সনাতন থেকে যবন হরিদাস সকলেই ছিলেন। তাঁর প্রচারিত ধর্মমত নিম্নশ্রেণীর মানুষের মধ্যে এক নতুন আধ্যাত্মিক জীবন ও জ্ঞানের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। তাঁর প্রচারিত ধর্মমত “গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম” নামে পরিচিত। তাঁর অনুগামীদের কাছে তিনি 'বিষ্ণুর অবতার' হিসেবে চিহ্নিত। তাঁর মতাদর্শ সাধারণ মানুষকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। পূর্বভারত তথা বঙ্গীয় জনজীবনে তাঁর সর্বাত্মক প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে ডঃ সুকুমার সেন মন্তব্য করেন যে, “তাঁর অপূর্ব প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হইয়া বাঙালীর প্রতিভা কি ধর্মে, কি দার্শনিক চিন্তায়, কি সাহিত্যে, কি সঙ্গীতকলায় সর্বত্র বিচিত্রভাবে স্ফূর্ত হইতে থাকে। ইহাই বাঙালী জাতির প্রথম জাগরণ।”