বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাব |
**বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাব**
বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাব অতুলনীয়। ধর্ম, সংস্কৃতি, জীবনাচরণ এবং কাব্যকলা—সবকিছুতেই তিনি এক নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন। তাঁর আগমনেই বাঙালি সমাজে নতুন ধারা শুরু হয় যা সাহিত্যিক মানসেও গভীরভাবে ছাপ ফেলে। চৈতন্যদেবের ভাবধারা ও দর্শন বাংলা সাহিত্যে অদ্বিতীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যা মধ্যযুগের বাঙালি সাহিত্যের একটি স্বর্ণযুগ তৈরি করে।
### চৈতন্যদেবের আগমনের পূর্বের বাংলা সাহিত্য
চৈতন্যদেবের আগমনের পূর্বে বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য, রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণের বিভিন্ন আখ্যান ছিল প্রধান। যদিও সেগুলো আধ্যাত্মিক এবং ধর্মীয় অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ছিল, কিন্তু শিল্পগুণে অনেকাংশেই সীমাবদ্ধ ছিল। মঙ্গলকাব্যের আঙ্গিক এবং ভাষা সাধারণের জন্য সহজবোধ্য হলেও, তা উচ্চমার্গের সাহিত্য হিসেবে গণ্য হত না। ভাষার সরলতা এবং সাহিত্যিক মানের অভাব তখনকার সাহিত্যকে একটি বিশেষ সীমার মধ্যে আটকে রেখেছিল।
### বৈষ্ণব আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ
চৈতন্যদেবের উপস্থিতি বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল। তাঁর প্রচারিত নাম সংকীর্তন ধর্ম ও ভক্তি আন্দোলন বাঙালি সমাজে বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি এক গভীর আস্থা তৈরি করে। তাঁর ভক্তি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় নতুন প্রেরণা দেয়। চৈতন্যের ভাবাদর্শকে কেন্দ্র করে ভক্তি সাহিত্যের বিকাশ ঘটে, যা বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন রসের সৃষ্টি করে।
### চৈতন্যদেব ও বৈষ্ণব পদাবলী
চৈতন্যদেবের প্রচারিত ধর্ম ও তার দর্শন বৈষ্ণব কবিদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। বৈষ্ণব পদাবলীর মাধ্যমে চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাস প্রমুখ কবিরা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা ও ভক্তির অনুপম বর্ণনা করেন। বৈষ্ণব পদাবলী বাংলার সাহিত্যভাণ্ডারে এক বিশাল স্থান অধিকার করে। পদাবলী কাব্য শুধু আধ্যাত্মিক প্রেমের উদ্ভাস নয়, তা চৈতন্যের ভাবাদর্শকেও ধারণ করে।
### গৌরাঙ্গ চরিত ও বাংলা সাহিত্যে চরিতকাব্য
চৈতন্যদেবের জীবন ও কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে রচিত হয় গৌরাঙ্গ চরিত। চরিত সাহিত্য চৈতন্যের সময়কাল থেকে বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন শাখার জন্ম দেয়। বৃন্দাবন দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, লোচন দাস প্রমুখ কবিরা চৈতন্যদেবের জীবনী অবলম্বনে অমর সাহিত্য রচনা করেন। এইসব চরিত সাহিত্য শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবন বা ধর্মীয় দর্শনের বর্ণনা নয়, বরং তা সেই সময়ের বাঙালি সমাজের এক চিত্রও তুলে ধরে।
### চৈতন্যদেব ও বাংলা ভাষার উন্নয়ন
চৈতন্যদেবের প্রভাব কেবল সাহিত্যিক রচনায় সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁর প্রভাবে বাংলার ভাষাও সমৃদ্ধ হয়। বৈষ্ণব কবিরা সংস্কৃত ভাষা থেকে তৎসম শব্দাবলীর প্রাচুর্য নিয়ে এসে বাংলা ভাষার গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য বাড়িয়েছিলেন। এর ফলে বাংলা ভাষা শিষ্ট সাহিত্যের উপযোগী হয়ে ওঠে। চৈতন্যের দর্শনের ছোঁয়ায় বাংলা সাহিত্য যে উচ্চমার্গে পৌঁছায়, তা আজও অবিস্মরণীয়।
### চৈতন্যদেবের প্রভাবিত কবি ও সাহিত্য
মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি কৃত্তিবাস, মকুন্দরাম, নারায়ণ দেব প্রমুখ চৈতন্যের ভক্তি আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁদের কাব্যে বৈষ্ণব ধর্ম ও দর্শন তুলে ধরেন। তাঁদের রচনায় ভক্তির মহিমা, ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন এবং আধ্যাত্মিক প্রেমের সুষমা প্রকাশ পেয়েছে। কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’ এর তরণীসেন চরিত্র এবং অন্যান্য আখ্যানে চৈতন্যের ভাবধারা প্রকাশ পেয়েছে।
### বাংলা সাহিত্যের নতুন রূপায়ণ
চৈতন্যদেব বাংলা সাহিত্যে মানবিক চরিত্রকে নতুন এক দেবত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। আগে যেখানে দেবতারা সাহিত্যের মূল উপজীব্য ছিল, চৈতন্যের মাধ্যমে মানব চরিত্রও সাহিত্যিক মানসে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ‘গৌরচন্দ্রিকা’ কাব্যে রাধা-কৃষ্ণ প্রেমলীলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চৈতন্যের অনুরূপ রচনা গড়ে ওঠে। গোবিন্দ দাসের অনেক পদাবলীই গৌরাঙ্গ বিষয়ক যা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূচনা করে।
### চৈতন্যদেবের প্রভাবিত সমাজচিত্র
চৈতন্যদেবের জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত চরিত সাহিত্য সেই সময়ের সমাজের এক বাস্তব চিত্রও তুলে ধরে। তাঁর আশীর্বাদে বাঙালি সমাজে একটি নবজাগরণের শুরু হয়। চৈতন্যের প্রভাবে বাংলার মানুষ সামাজিক এবং ধর্মীয় দিক থেকে আরও সমৃদ্ধ হয়। চৈতন্যের ভক্তি আন্দোলন বাঙালির আত্মপরিচয় এবং সাহিত্যিক জাগরণে অপরিসীম ভূমিকা রাখে।
### উপসংহার
চৈতন্যদেবের প্রভাব বাংলা সাহিত্যের উপর এতটাই গভীর ছিল যে তাঁর যুগ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়। বৈষ্ণব পদাবলী, চরিত সাহিত্য এবং ভাষার শুদ্ধতায় চৈতন্যদেবের অবদান বাঙালি সাহিত্যিক ও সংস্কৃতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বাঙালীর ধর্মে-কর্মে মননে চৈতন্য এনেছিলেন
নবজাগরণ। একটি নির্জিত জাতি তার কাঙ্ক্ষিত প্রেরণা লাভ করল চৈতন্যের
আবির্ভাবে। জীবনাচরণে ও ধর্মের আচারসর্ব তার পরিবর্তে দেখা দিল হৃদয়ান
ভূতি। অন ভবের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ চিরকালই তো সাহিত্য। বাংলা সাহিত্য তাই
চৈতন্য জীবনী ও বাণীতে নবরসে উজ্জীবিত হল ।
মঙ্গলকাব্যগুলির গতান,গতিক ধারায়,
ক.ফপ্রেম-আখ্যানে অথবা রামায়ণ-মহাভারত ইত্যাদি পরাণ-অন বাদে উন্নত
সাহিত্যিক গুণাবলীর অভাব ছিল চৈতন্যপূর্ব যুগে । চৈতন্যের সমকালে এবং
পরবর্তী তিনশ' বছরে পণ্ডিত ও রসজ্ঞ ব্যক্তিরা সাহিত্য- সেবায় অগ্রসর হলে
ভাষার গাম্ভীর্য ও প্রকাশলাবণ্যে পূর্বেবর্তী সাহিত্য-উপাদান শ্রেষ্ঠ
সাহিত্যে উন্নীত হল। চৈতন্য চরিত্রের প্রভাব তখন নায়ক চরিত্রে,
চৈতন্যধর্মে'র প্রভাব ঘটনা সন্নিবেশে। কৃত্তিবাস, মকুন্দরাম অথবা
নারায়ণদেব, মধ্যযুগের সব শ্রেষ্ঠ কবিই বৈষ্ণবধর্ম' দ্বারা প্রভাবিত হয়ে
চরিত্র-নির্মাণ করেছেন, ঘটনা সন্নিবেশিত করেছেন তাঁদের কাব্যে, যা ভক্তির
প্রকাশ বা বৈষ্ণবীয় চিন্তারই নামান্তর। কৃত্তিবাস চিত্রিত তরণীসেন
রামভক্ত, কিন্তু তার ভক্তির প্রকাশ বৈষ্ণব রীতিরই অনুগামী। সর্বোপরি,
চৈতন্য-অননুসারীদের চেষ্টায় তৎসম শব্দবহুল বাংলাভাষা তখন শ্রেষ্ঠ সাহিত্য
রচনার উপযোগী। বৈষ্ণব কবিরা শ্রীমদ্ভাগবত অনুবাদ করেছেন, সংস্কৃতে
সাহিত্যের অনুসরণে বাংলায় কাব্য রচনা করতে গিয়ে তৎসম শব্দবাহুল্যে
প্রচলিত সাহিত্যধারাকে তাঁরা যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছেন। ধর্মমঙ্গল কাব্য ভাগবতের আদর্শেই রচিত। রামচন্দ্র ও কৃষ্ণ, বিষ্ণুর অবতার রূপে পরিচিত
হওয়ায় রামায়ণ-মহাভারত ও বিষ্ণু পরাণের সঙ্গে বাঙালীর একটি অচ্ছেদ্য
সম্বন্ধও স্থাপিত হয়।
চৈতন্যের বাণী, 'কলিযুগে ধর্ম হয় নাম-সংকীর্তন। তিনি ও তাঁর অন, চরবন্দ নাম সংকীর্তনকে সাধনা রূপে গ্রহণ করায় বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের বিকাশ সম্ভব হল। চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখ শ্রেষ্ঠ পদরচয়িতারা চৈতন্যধর্মকে আশ্রয় করেই বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ এই তিনশ' বছর ধরে বাংলা সাহিত্যের একটি মূখ্যে ধারা বৈষ্ণবপদাবলী সাহিত্য।
এতদিন দেবতাই ছিলেন বাংলা সাহিত্যে উপজীব্য। চৈতন্যের দেবোপম চরিত্রকে উপলক্ষ করে মানব দেবতার আসন গ্রহণ করল। রচিত হল 'গৌরচন্দ্রিকা'- রাধাকৃষ্ণে প্রণয়লীলার অনুসরণে গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ।
গোবিন্দ দাসের অনবদ্য পদাবলীর অনেকগুলিই গৌরাঙ্গ বিষয়ক অথবা 'গৌরচন্দ্রিকা'র পদ। চৈতন্য যেহেত, 'অন্তঃকৃষ্ণ বহি'গৌর, রূপে ভাবিত হয়ে। একই অঙ্গে রাধা ও কৃষ্ণর পে কল্পিত হয়েছেন রাধাকৃষ্ণে লীলান, সরণে গৌরচন্দ্রিকায় চৈতন্যের অনরপেভাবের পদ রচিত হয়ে বাংলা সাহিত্যে নব পদধারার সূচনা করল।
চৈতন্য-জীবন-মহিমা প্রচারে তাঁর জীবনী অবলম্বনে চরিত-সাহিত্যও রচিত হল । দেখা দিলেন বাংলা সাহিত্যের চরিত-সাহিত্য রচয়িতা বৃন্দাবন দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, জয়ানন্দ, লোচন দাস প্রমুখে কবিগণ । মাননুষের জীবনীও যে শ্রেষ্ঠ কাব্য-সাহিত্যে রূপায়িত করা সম্ভব তারই নিদর্শন উপহার দিলেন তাঁরা। শখ, চৈতন্য জীবনী নয়, তাঁর অনচের অদ্বৈত, নিত্যানন্দ প্রমুখের জীবনী অবলম্বনেও সাহিত্য রচিত হয়েছে । এ-সবই চৈতন্যের প্রভাবের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ফল ।
প্রাচীন ও মধ্য যুগের বাঙালী ইতিহাস সম্পর্কে উদাসীন। তাই এই কালপর্বে কাব্য যত রচিত হোক, ইতিহাস নিষ্ঠার পরিচয় তেমন পাওয়া যায় না। কাব্যের মধ্যে প্রসঙ্গত ইতিহাস আলোচনা যতটকে, আছে তা-ই আমাদের সম্বল। চৈতন্য, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত অথবা তাঁর পত্নী সীতাদেবীর জীবনী নিয়ে যে চরিত্রসাহিত্য রচিত হয়, তাতে শঙ্খ, ব্যক্তিগত জীবন কথাই নাই, আছে সমসাময়িক ইতিহাস। সে ইতিহাস যেমন সমকালীন বৈষ্ণব সমাজের, তেমনি বাঙালী সমাজেরও। চৈতন্যের আবির্ভাবের ফলশ্রুতিতেই তা লাভ করা গিয়েছিল।
প্রাক-চৈতন্যয,গের কবিদের রচনায় বাংলাভাষার বিশিষ্ট রূপটি ফুটে উঠেছিল, কিন্তু তার সাহায্যে মহৎ কাব্যসৃষ্টি সম্ভব হয়নি। তাকে শিষ্ট সাহিত্যের উপযোগী করা গেল চৈতন্যের আবির্ভাবের ফলে। কতে যা ছিল গ্রামীণ সাহিত্যে সীমাবদ্ধ,