সাহিত্যে ও সমাজজীবনে চৈতন্যদেব | বাঙালী সমাজজীবনে চৈতন্যের প্রভাব

সাহিত্যে ও সমাজজীবনে চৈতন্যদেব
(চৈতন্যজীবন কথা অষ্টম অধ্যায়ে )
বাঙালী সমাজজীবনে চৈতন্যের প্রভাব


শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব বাঙালী সমাজজীবনে একটি যুগান্তকারী ঘটনা । দিব্যপরেষে চৈতন্যের আবির্ভাব ১৪৮৬ খীঃ ফাল্গুনী দোলপূর্ণিমার দিন, তিরোধান ১৫৩৩ খ্রীঃ । তাঁর এই স্বল্পকালীন মত' লীলায় তাঁর বহিরঙ্গ জীবনে ঘটনার ঘনঘটা দেখা দেয়নি। তব, যা-কিছ, ঘটেছে তার সবই বাঙালীর কাছে বিশেষ তাৎপর্যময়—বাঙালীর সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য – বাঙালীর সকল মানস- সম্পদের উপরই তার প্রভাব চিরকালীন। একক ব্যক্তিত্বে একটি জাতির সংস্কৃতিকে এতখানি প্রভাবিত করা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম মনীষীর পক্ষেই সম্ভব হয়েছে ।

নব্যন্যায় চর্চার পীঠস্থান নবদ্বীপে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। প্রথম জীবনে তিনিও ছিলেন শিক্ষক। তেইশ বছর বয়সে গয়াধামে পিতৃকৃত্য করতে গিয়ে বিষ্ণুপাদপদ্ম দর্শনে তাঁর মনে দেখা দিল অপূর্ব ভাব-মাধ্য"। ভক্ত-সন্ন্যাসী ঈশ্বর পরীর কাছে তিনি গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত হলেন। ভাবোত্ত কৃষ্ণপ্রেম-পাগল নিমাই ফিরে এলেন নবদ্বীপে। মধুময় কৃষ্ণপ্রেম শ্রীবাসের অঙ্গন ছাড়িয়ে নগরের পথে পথে ধ্বনিত হল তাঁরই উৎসাহে। নগরীর কোলাহলময় জীবনে একে অভিশাপ রূপেই গ্রহণ করল শাসকশ্রেণী। কিন্তু নিমাই-এর চেষ্টায় প্রকাশ্য নামসংকীর্তনে স্বাধীনতা পেল বৈষ্ণব সমাজ । অতঃপর চব্বিশ বছর বয়সে কাটোয়ায় কেশব ভারতীর কাছে মন্ত্রদীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন নিমাই। সন্ন্যাসজীবনে তাঁর নাম হল শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, সংক্ষেপে শ্রীচৈতন্য। পরিব্রাজক বেশে সারা ভারত পরিক্রমার পর জীবনের শেষ আঠার বছর তাঁর কাটল নীলাচলে। সেখানেই তিনি ইহলীলা সংবরণ করেন।

চৈতন্যের আবির্ভাবের সময়ে বাংলাদেশে হিন্দ ও ইসলাম দুটি ধর্ম প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। ইসলাম ধর্ম তখন রাজার ধর্ম, রাজার প্রতাপে তারও প্রতাপ ;- আর হিন্দুধর্ম হয়ে উঠেছিল আচার ও মনন প্রধান ধর্ম । বৌদ্ধ ও তান্ত্রিক আচার দেবীতত্ত্ব ও পূজাপদ্ধতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিল তুর্কী আক্রমণের ফলে। সূতরাং

শক্তির জাগরণে ( মানসিক
ও সামাজিক ) দৈবীশক্তির আরাধনায় তন্ত্রোক্ত আচারের
প্রতি নিষ্ঠাই হয়েছিল তখন বাঙালীর লক্ষ্য। আচারের বিকল্প তখন বিচার।
ন্যায় চর্চা বাংলাদেশে বহুল প্রসার লাভ করেছিল। চৈতন্যের জন্মস্থান
নবদ্বীপই ছিল নব্যন্যায় চর্চার পীঠস্থান। এই আচার ও বিচারের সীমিত
ক্ষেত্রকে আবেগের প্লাবনে চৈতন্য ভাসিয়ে দিলেন—প্রতিষ্ঠিত করলেন ধর্মের
ক্ষেত্রে হৃদয়াবেগকে। বাঙালীর মননে তার ফলে যে অভাবিত পরিবর্তন দেখা দিল
তাকে অনেকে 'চৈতন্য রেনেসাঁস'

 অভিধায় আখ্যাত করেছেন। বস্তুত উনিশ শতকীয় নবজাগরণের আগে বাঙালী সমাজ জীবনে চৈতন্যই রেনেসাঁস বা নবজাগরণের বীজ বপনে সমর্থ হন।


চৈতন্য প্রবর্তিত ধর্মে'র নাম গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম। বাংলাদেশ, উড়িষ্যা, মণিপুর, দক্ষিণ ভারত ও পশ্চিমে বৃন্দাবন পর্যন্ত এই ধর্ম মতের বিস্তার ঘটে। উড়িষ্যার রাজা প্রতাপরুদ্র বিজয়নগরের মহামন্ত্রী রামানন্দ, চৈতন্য প্রবর্তিত ধর্মে'র প্রতি অনুরক্ত হন। গৌড়রাজ হাসেন শাহের দুই মন্ত্রী রূপে ও সনাতন চৈতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ফলে চৈতন্যের আবির্ভাব ভারতীয় সমাজজীবনে একটি নতেন ধর্ম মতের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটায় যে ধর্মের মূল কথা, 'কলিযুগে ধর্ম' হয় নামসংকীর্তন', 'প্রেমধন আর্তি বিনে না পাই কৃষ্ণেরে'। এই প্রেমধর্মের প্লাবনে বাঙালী সমাজ- জীবনে জমা ক্লেদ দীর্ঘদিন পরে ধুয়ে মুছে যায়।
এবং
ব্
রাহ্মণ্যধর্মের সংকীর্ণতা ও অহমিকায় অভিমানী তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণী আত্মরক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠায় দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছিল। বৌদ্ধরাও অনেকে ব্রাহ্মণদের নিপীড়নে উত্ত্যক্ত হয়ে একই পন্থা অনঃসরণ করে। চৈতন্য-প্রবর্তিত ধর্ম তাদের জন্য একটি নতেন ধর্মের সন্ধান দিল, যে-ধর্মে জাতিভেদ নাই, জাতি- বিদ্বেষ নাই, মানুষে মানুষে ভেদ নাই, আছে পারস্পরিক প্রীতিবোধ এবং অহমিকার পরিবর্তে বিনয়। এই বিকল্প ব্যবস্থাই গ্রহণীয় হয়েছিল সর্বস্তরের বাঙালীর কাছে। ফলে নতেন ভাবাদর্শে নব সমাজ সংগঠনে প্রাণিত হয়েছিল বাঙালী।

শাসক মুসলমানের কাছে সাধারণ হিন্দ, ছিল উপেক্ষিত নাগরিক। তাদের ধর্মাচরণে নানা বাধা-বিপত্তি ছিল। প্রাণের ভয়ে বাঙালীও এই ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছিল। এমনকি একাংশের ধারণা ছিল, হিন্দুর পাপের ষোলকলা পূর্ণ হতেই আল্লার পে দেখা দিয়েছেন ভগবান, সুতরাং সামাজিক অবিচার পাপের প্রায়শ্চিত্ত, বিধাতারই বিধান। বাঙালীর এই বিচিত্র সহনশীল মানসিকতায় মননুষ্যত্বের পাতবারিধারা সিঞ্চন করলেন শ্রীচৈতন্য, উৎপীড়িতের রক্ষাকবচ। নবদ্বীপের একদল নাগরিকের আবেদনে কাজি যখন প্রকাশ্যে নামসংকীর্তন বন্ধ করার আদেশ দিলেন, শ্রীচৈতন্যের ক্ষোভ ও ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সে আদেশ প্রত্যাহার করতে হল কাজিকে। রক্তচক্ষু, পরাজিত হল দেবোপম পৌরুষের কাছে। বাঙালী জানল সহ্য নয়, প্রতিবাদই প্রতিকারের একমাত্র অস্ত্র। বাঙালীর নির্জিত জীবনে ভয়াবহ লতার পরিবর্তে দেখা দিল প্রাণচাঞ্চল্য ।
শাসকের

শাসককালের অন করণে অভিজাত বাঙালীজীবনে তখন ইসলামী রীতির প্রতি আন,গত্য প্রবল। অভিজাত্যের চিহ্ন হয়েই তা দেখা দিয়েছে ।

এর ফলে বাঙালী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তখন বিপর্যয়ের মুখে। এই সংকটের
দিনে হিন্দুর সংস্কৃতি- চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে বাঙালী সংস্কৃতিকে
স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করলেন শ্রীচৈতন্য – জগাই-মাধাই-এর মতো দুর্বত্ত
রাজকর্মচারীও দীক্ষিত হল তাঁর নবমন্ত্রে। সাংস্কৃতিক নবজাগরণ শ্রীচৈতন্যের
স্মরণীয় অবদান ।

 তারই প্রভাব বাঙালীর প্রাত্যহিক সমাজ-জীবনে, তার আচারে-ব্যবহারে বৈষ্ণবীয়
বিনয়, তুলসীর গলকন্ঠী, পুরোহিতের নামাবলি, দেহে গঙ্গামৃত্তিকায় নাম ও
পদাঙ্ক ধারণ, গৃহসম্মুখে তুলসীকঞ্জ স্থাপন, গার্হস্থ্য অনষ্ঠানে ও মৃতের
সৎকার যাত্রায় নামসংকীর্তন ইত্যাদি রীতিগুলির বহুল প্রসার তাঁর প্রবর্তিত
বৈষ্ণব ধর্মেরই ফলশ্রুতি।


গতান,গীতিকায় রুদ্ধস্রোত সাহিত্যও পেল গতির সন্ধান। মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি প্রচলিত সাহিত্যধারা যেমন সঞ্জীবিত হল, তেমনই নবীন একাধিক ধারা সংযুক্ত হল । সঙ্গীতম,খের সমাজে আবির্ভাব ঘটল শতকবির — রচক শখে, হিন্দ, নয় ম, সলমানও, গায়কের ও শ্রোতার দলেও তাদের স্থান। সঙ্গীতপ্রেমে মহাসম্মিলন ঘটল হিন্দ- মাসলমান দুটি সম্প্রদায়ের। সাহিত্যের পরোক্ষ প্রভাবে সমাজ-জীবনেও বিবর্তন দেখা দিল। এইভাবে বাঙালীর চিন্তা-ভাবনা-কল্পনায়, কর্মসাধনায় ও জীবনচর্যায় শ্রীচৈতন্য হয়ে থাকলেন এক শাশ্বত প্রাণপরবে।


NurAlam

Hello there! I'm Nur Alam Miah, a passionate and Open-minded individual with a deep love for blog, article,writer. I believe that life is a continuous journey of learning and growth, and I embrace every opportunity to explore new avenues and expand my horizons. In terms of my professional background, I am a Blog Writer with a focus on writing improve. Throughout my career, I have learn unique blog article. I am dedicated to my work.facebooktwitter instagrampinteresttelegramwhatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

Ad

Magspot Blogger Template

Ad

amazon.in
amazon.in

نموذج الاتصال