চণ্ডীমঙ্গল কাব্য

 চণ্ডীমঙ্গল কাব্য


"দেবী চণ্ডীর আখ্যান সংচক কাব্য চণ্ডীমঙ্গল কাব্য । বাংলা সাহিত্যে চ'ডীমঙ্গল কাব্যের আবির্ভাব মনসামঙ্গলের পরে, কিন্তু বাংলা দেশে চণ্ডী অতি প্রাচীন দেবী। আর্য আগমনের আগে থেকেই চণ্ডী অস্ত্যজ শ্রেণী দ্বারা পাজিত হয়েছেন। মার্কণ্ডেয় পরাণেও (খত্রীঃ ৩য় শতক) দেবী চণ্ডীর বিস্তৃত পরিচয় আছে। ইনি অসুরদলনী, মহিষাস রবিনাশিনী। ইনি শিবপত্নী, শিব-শক্তিও। অপৌরাণিক ও পৌরাণিক এই দুই ধারার মিলন ঘটেছে চণ্ডীমঙ্গল
কাব্যে ।

'চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী


দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্যমূলক কাব্য চণ্ডীমঙ্গল কাব্য । এই কাব্যের দুটি কাহিনী 'যথাক্রমে 'আখেটিক খণ্ড' ও 'বণিক খণ্ডে' বিবৃত হয়েছে। আখেটিক অর্থ— ব্যাধ । এতে প্রমাণ পাওয়া যায়, দেবী চণ্ডীর পূজা প্রথমে আর্যেতর সমাজে প্রচলিত হয় এবং পরে অভিজাত শ্রেণীর (বণিক) মাধ্যমে এই পূজোর প্রচলন সমাজের 'সর্বস্তরে ঘটে।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রথমে আছে হর-পার্বতীর লীলা। এই বর্ণনার পরে শত্রু হয়েছে যথাক্রমে 'আখেটিক খণ্ড' ও 'বণিক খণ্ড'।

আখেটিক খণ্ড : 

দেবী চণ্ডীর অভাবের সংসার। তাঁর স্বামী শিব আত্মভোলা, শ্মশানবাসী ভিক্ষোপজীবী। স্বামী-স্ত্রী সখের মখে দেখেন না, নিত্য করেন ঝগড়া। সহচরী পদ্মা দেবীকে উপদেশ দিলেন মর্তে পূজো প্রচলিত হলেই তাঁর দুঃখ ঘুচবে। চণ্ডী চাইলেন ইন্দ্রের পত্র নীলাম্বরকে দিয়ে মতে তাঁর পূজোর প্রচলন। এ ব্যাপারে তিনি শিবের সাহায্যও চাইলেন। কিন্তু নিরপরাধ নীলাম্বরকে শিব মতে পাঠান কি করে !

দেবী নিলেন ছলনার আশ্রয় । ইন্দ্র শিবোপাসক। পূজার ফল তোলার ভার নীলাম্বরের উপর। একদিন দেবীর মায়ায় স্বর্গের উদ্যানে কোনো ফল দেখতে না পেয়ে নীলাম্বর মর্তে এল পষ্পসংগ্রহে। সে দেখতে পেল ব্যাধের মত্ত জীবন । কামনা করল সেই স্বাধীন জীবন। এদিকে তার অন্যমনস্কতার অবসরে ফলের মধ্যে চণ্ডী কটি রূপে আশ্রয় নিলেন এবং ইন্দ্র যখন শিবের উদ্দেশে পূজোর ফলে নিবেদন করছিলেন, তিনি শিবকে দংশন করলেন। বিষে কাতর শিব ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিতে চাইলেন ইন্দ্রকে। অবশেষে নীলাম্বরের ভালেই ফালে কাঁট থেকেছে এবং ফলে তোলার সময় সে ব্যাধের জীবন কামনা করেছিল জেনে শিব তাকে মতে"
ব্যাধর,পে জন্মাবার অভিশাপ দিলেন। ধর্ম কেতর পত্রে কালকেত, রূপে জন্ম নিল
নীলাম্বর, আর সঞ্চয়কের কন্যা ফলেরা রূপে তার পত্নী ছায়া।

এগার বছর বয়সে রূপবান কালকেতুর সঙ্গে বিয়ে হল ফলরার। পিতামাতার বার্ধক্যে সংসারের ভার পড়ল তাদের উপর। কালকেত, যেমন সাহসী তেমনি অব্যর্থ লক্ষ্য। নিয়মিত সে পশ, শিকার করে আনে আর ফলরা হাটে-বাজারে সেই মাংস বিক্রি করে। অনটন সত্ত্বেও তাদের সুখী জীবন। এদিকে কালকেতর পরারুমে কাতর কলিঙ্গ দেশের বন্য পশরে দল প্রাণের দায়ে দেবী চণ্ডীর শরণাপন্ন হল। দেবীও তাদের অভয় দিলেন। তিনি একদিন সোনালি গোসাপের রূপ ধরে বনের পথে পড়ে রইলেন আর মায়া বিস্তার করে অদৃশ্য করে দিলেন সমস্ত পশ কলকে। যাত্রাপথে স্বর্ণ গোধিকা দর্শন অমঙ্গলস,চক। কালকেত, তা দেখে বিরক্ত হল এবং কোনো পশর সাক্ষাৎ না পেয়ে তাকেই বেধে আনল। উদ্দেশ্য, সেদিন তারই মাংস খাবে। শিকারহীন দিনটি বিষণ্ণ করল ফলরাকে। কারণ, তারা যে দিন আনে দিন খায়। ফলেরা চলল সইয়ের বাড়ি থেকে খুদে ধার করতে, আর কালকেত, বাসি মাংসের পসরা নিয়ে বাজারে। উভয়ের অন;পস্থিতিতে বন্দী চণ্ডী রূপবতী নারীর রূপে ধারণ করে বসে রইলেন। গৃহে ফিরে ফলেরা তাঁকে দেখে স্বামীর চরিত্র সম্পর্কে সন্দিগ্ধ হল, কালকেত, হল বিস্মিত। পরিশেষে কালকেতুর সরলতা ও অকপটতার পরিচয় পেয়ে দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাকে দিলেন সাতঘড়া ধন ও একটি অঙ্গরীয়। সেই অর্থে বন কেটে প্রতিষ্ঠিত হল গজরাট নগর। সব সম্প্রদায় ও ধর্মের লোক সেখানে সাথে বসতিস্থাপন করল। কিন্তু সেইসঙ্গে এল ভাঁড়, দত্ত নামে এক শঠ ব্যক্তি । কালকেত, তাকে সযোগ-স,বিধা দিল, কিন্তু তারই সংযোগে সে নানা অন্যায়ভাবে তার বৃদ্ধি ও বাক চাত যে মগ্ধে অর্থাগম করতে লাগল । দেশবাসীর অভিযোগে কালকেত, তাকে নির্বাসিত করল * তার রাজ্য থেকে। ভাঁড়, দত্ত তখন পার্শ্ববর্তী রাজ্য কলিঙ্গের রাজাকে উত্তেজিত করে তাকে দিয়ে কালকের বিরদ্ধে যুদ্ধ করাল। রণক্লান্ত কালকেত, যখন বিশ্রাম ও আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিল, ভাঁড়র কৌশলে সে বন্দী হল কলিঙ্গরাজের হাতে এবং নিক্ষিপ্ত হল কারাগারে। দেবী চণ্ডীর স্বপ্নাদেশে কলিঙ্গরাজ কালকেত,কে মাজি দিলেন। তার রাজ্যও ফিরিয়ে দিলেন। দেবীর কৃপায় তার মতে সৈন্যরাও পনের্জীবিত হল। কালকেত, সানন্দে ফিরল নিজ রাজ্যে। উপায়ান্তর না দেখে ভাঁড়, এবার কালকেতঃকে তষ্টে করতে মনোযোগী হল । কিন্তু তার সে চেষ্টা ব্যর্থ- হল। কালকেত, তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল। অবশ্য পরে তার সীমাহীন দঃখকষ্ট দেখে তাকে ক্ষমাও করল। কালকেত, দেবী চণ্ডিকার মন্দির বানিয়ে মর্তে দেবীর পূজা প্রচারের যথাযোগ্য ব্যবস্থা করল। কিছুকাল সখে রাজত্ব করল কালকেত । ইতিমধ্যে তাদের অভিশাপের দিন শেষ হল, দেবীর উদ্দেশ্যও হয়েছে সিদ্ধ। পাত্রের হাতে রাজ্যপাট অর্পণ করে স্বর্গে ফিরে গেল নীলাম্বর ও ছায়া। আখেটিক খণ্ডের এখানেই সমাপ্তি। 

ৰণিক খণ্ড :


বণিক খণ্ডে অভিজাত বণিক পরিবার দ্বারা মর্তে চণ্ডীপূজা প্রচলনের কথা বলা হয়েছে।

স্বর্গের অপ্সরা রত্নমালা। চণ্ডী চাইলেন তাকে দিয়ে মর্তে নিজ পূজো প্রচলিত
করতে। সতরাং সরসভায় নৃত্যের সময়ে তালভঙ্গ হল রত্নমালার। চণ্ডী তাকে
অভিশাপ দিলেন। লক্ষপতি বণিকের ঘরে জন্ম নিল রত্নমালা। নাম খুলনা ।
পায়রা ওড়ানো তাঁর এক শখ ।
উিজানী নগরের বণিক-প্রধান ধনপতি সদাগর । একদিন তাঁর এক পায়রা আশ্রয় নিল
খুলনার অঞ্চলে।
পায়রার খোঁজে এসে
ধনপতি দেখলেন খুলনার অতুলনীয় রূপে। ধনপতি বিবাহিত এবং তাঁর পত্নী লহনা
বন্ধ্যা। ধনপতির আগ্রহে খুলনার সঙ্গে বিবাহ হল তাঁর। আপত্তি দূরে হল একটি
পট্টবস্ত্র ও পাঁচ তোলা সোনা অলংকারের জন্য দিয়ে।
লহনার তীব্র

রাজার প্রিয় পাখি শুক-সারি। তাদের জন্য চাই সোনার খাঁচা। রাজা ধনপতিকে ডেকে আদেশ দিলেন সোনার পিঞ্জরের জন্য : 'ধনপতি যাও ভায়া গোঁড় নগরে'। ধনপতি যখন বাণিজ্যযাত্রায়, দূর্বলা দাসীর প্ররোচনায় লহনা অসীম কষ্ট দিল খুলনাকে। একটি জালপত্র দেখিয়ে সে খুলনাকে বনে বনে ছাগল চরাতে পাঠাল, শতে দিল ঢে'কিশালে, খেতে দিল এক বেলা আধপেটা, পরতে দিল 'খঞা' কাপড়। এই চরম লাঞ্ছনার দিনে চন্ডীর সহচরীরা তাকে শিখিয়ে দিল মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত পালন করতে। খুলনা ব্রত পালন করে দেবীর কৃপা লাভ করল। দেবীর নাদেশে লহনা খুলনার প্রতি সম্প্রীতি আচরণও করল। ধনপতি দেশে ফিরে ! এলে

খুলনারও সুখের দিন ফিরে এল। কিন্তু ধনপতির সঙ্গে আত্মীয়দের বিরোধ বাধল। তারা ধনপতিকে জব্দ করার জন্য জানাল ধনপতির অনুপস্থিতিতে খুলনা বেড়িয়েছেন বনেজঙ্গলে হয় তিনি তাঁর সতীত্বের পরীক্ষা দিন অথবা ধনপতি জরিমানা হিসাবে দেবেন এক লক্ষ টাকা। ধনপতি অর্থদণ্ড দেওয়া সমীচীন মনে করলেও খলেনা আপন সতীত্বের পরীক্ষা দেওয়াই স্থির করলেন। সসম্মানে তিনি উত্তীর্ণ হলেন কঠিন পরীক্ষাগুলি। লোকে ধন্য ধন্য করল ।
 
রাজার এবার দরকার নীলা, পলা, খুলনার সখের দিন দীর্ঘস্থায়ী হল না।
লবঙ্গ, চন্দন, চামরাদি। সেজন্যে ধনপতিকে যেতে হবে সিংহলে। যাত্রালগ্নে
চিন্তিত খুলনা স্বামীর মঙ্গলকামনায় ঘট পেতে চন্ডীর পূজোয় বসল। ধনপতি
শিবভক্ত, স্ত্রীর চ'ডীপুজো তাঁর সহ্য হল না। চণ্ডীর ঘট তিনি পায়ে ঠেললেন।
কপিতা হলেন চড়া। সিংহলের পথে ঝড়ে ধনপতি দেবীর কোপে হারালেন তাঁর ছটি
নৌকা। একমাত্র 'মধকের' রক্ষা পাওয়ায় তিনিও প্রাণে বাঁচলেন। সিংহলের পথে
কালীদহ। দেবী সেখানে সুন্দরী নারীর বেশে পদ্মের উপর বসে একটি হাতি গিলে
পরক্ষণেই তাকে উগরিয়ে ফেলতে লাগলেন । এই অদ্ভুত দৃশ্যে দেবীর মায়ায়
দেখতে পেলেন কেবল ধনপতি। ধনপতির উপঢৌকনে সন্তুষ্ট সিংহলরাজ তাঁর -মুখে 'কমলে কামিনীর কাহিনী শনে বিশ্বাস করতে পারলেন না। রাজা তাঁকে
মিথ্যাবাদী ভাবায় ধনপতির রোখ চেপে গেল। স্থির হল 'কমলে কামিনী' দেখাতে
পারলে রাজা দেবেন ‘অর্ধ‘রাজ্য, অর্ধ সিংহাসন'; না দেখাতে পারলে ধনপতির
ডিঙার সব সম্পত্তি হবে রাজার, আর তাঁকে কাটাতে হবে বন্দীজীবন। ধনপতি কিন্তু
তাঁর প্রতি দেবীর অসন্তোষে সেই অভ‚তপূর্বে দৃশ্য দেখাতে ব্যর্থ হলেন।
সতরাং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন তিনি।

এদিকে খুলনা হয়েছেন পুত্রবর্তী। তাঁর পুত্র শ্রমন্ত অভিশাপগ্রস্ত গন্ধব মালাধর। মায়ের অশেষ যত্নে সে লালিতপালিত। মেধাবী শ্রীমন্তর, দনাই-এর কাছে বিদ্যাচর্চা করে। একদিন গরু, তার নিরদিষ্ট পিতাপ্রসঙ্গ তুলে একটা কটূক্তি করলে ক্ষুব্ধ শ্রমন্ত মায়ের আদেশ নিয়ে যাত্রা করল সিংহলে পিতার খোঁজে। একই ভাবে কালীদহে দেবীর মায়ায় সে দেখল 'কমলে কামিনী মূর্তি এবং সিংহলরাজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল যে এই আশ্চর্য দৃশ্য দেখাতে না পারলে ‘দক্ষিণ মশানে মোর বধিহ জীবন'। রাজাও পূর্বে বৎ প্রতিজ্ঞা করলেন । দেবীর অসন্তোষে একইভাবে ব্যর্থ ‘হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হল ভ্রমন্ত। সেখানে পিতাপত্রের মিলন ঘটল। শ্রীমন্তের মনে পড়ল দেবীপুজোর কথা। একাগ্রমনে সে দেবীর স্তব করল। এদিকে পাত্রের কল্যাণকামনায় খালনাও চণ্ডিকার যথারীতি সেবা করছেন। ফলে অষ্টা দেবী -মশানে বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর বেশে শ্রীমন্তকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করলেন। তাঁরই আজ্ঞায় ধনপতি ও শ্রীমন্ত পেল মুক্তি, সিংহলরাজকন্যা সংশীলার সঙ্গে বিবাহ হল শ্রীমন্তের। চণ্ডী ধনপতির সমদ্রেডোবা ডিঙা ও ধনরত্নও ফিরিয়ে দিলেন । দ্রব্যসত্ত্বার নিয়ে দেশে ফিরল পিতা ও পত্রে, সঙ্গে বধ। দেশে ফিরে শ্রীমন্ত রাজা. বিক্রমকেশরীকেও কমলে কামিনী মূর্তি দেখাল ।ফলে লাভ করল রাজকন্যা -রূপেবতীকে।



এতদিন ধনপতি চণ্ডীপূজা করেননি। একদিন শিবপূজায় বসে তিনি দেখলেন শিবের অর্ধাঙ্গ জুড়ে চণ্ডী শোভা পাচ্ছেন : বুঝলেন 'দুইজনে একজন মহেশপার্বতী'। ফলে তিনিও চণ্ডিকার সেবায় ব্রতী হলেন ।

ধনপতির পরিবার দ্বারা মর্তে" প্রচলিত হল চণ্ডীপূজা। চণ্ডীর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। শাপান্তে স্বর্গে ফিরে গেল খুলনা (রত্নমালা ) ও শ্রীমন্ত ( মালাধর ) ।


NurAlam

Hello there! I'm Nur Alam Miah, a passionate and Open-minded individual with a deep love for blog, article,writer. I believe that life is a continuous journey of learning and growth, and I embrace every opportunity to explore new avenues and expand my horizons. In terms of my professional background, I am a Blog Writer with a focus on writing improve. Throughout my career, I have learn unique blog article. I am dedicated to my work.facebooktwitter instagrampinteresttelegramwhatsapp

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

Ad

Magspot Blogger Template

Ad

amazon.in
amazon.in

نموذج الاتصال