পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে মাছের হরমোন নিষ্কাশনের প্রক্রিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ জৈবপ্রযুক্তিগত পদ্ধতি। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে মাছের পিটুইটারি গ্রন্থি সংগ্রহ করা হয়, যা মাথার ভেতরের একটি ছোট গ্রন্থি। সাধারণত, মৃত বা জ্যান্ত মাছ থেকে এই গ্রন্থিটি অপসারণ করা হয়। এরপর পিটুইটারি গ্রন্থিগুলো শুদ্ধ করে শীতল পরিস্থিতিতে সংরক্ষণ করা হয়। নিষ্কাশনের জন্য, গ্রন্থিগুলো ক্রাশ করে অথবা পিষে ফেলা হয় এবং এতে ফিজিওলজিক্যাল স্যালাইন বা নির্দিষ্ট দ্রাবক যোগ করা হয়। এই দ্রবণে হরমোনগুলি মিশ্রিত হয়ে যায়। তারপর এই দ্রবণটি ছাঁকা বা সেন্ট্রিফিউজ করা হয়, যাতে অপ্রয়োজনীয় কঠিন পদার্থগুলি অপসারিত হয় এবং হরমোন সমৃদ্ধ তরল সংগ্রহ করা যায়। এভাবে পাওয়া হরমোনগুলো মাছের প্রজনন নিয়ন্ত্রণে এবং কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়।এই প্রক্রিয়ায় যথাযথ তাপমাত্রা এবং নির্দিষ্ট পদ্ধতির অনুসরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে হরমোনের কার্যকারিতা বজায় থাকে এবং সফলভাবে প্রজনন ঘটানো সম্ভব হয়।
পিটুইটারি গ্রন্থির থেকে হরমোন নিষ্কাশন (Hormone extraction from pituitary glands)
কালো কাগজে মোড়া কাচের শিশিতে সংরক্ষিত গ্রন্থিগুলি শিশি থেকে বার করে ব্লটিং পেপারে শুষে নেওয়া হয়। ফলে অ্যাবসলুট অ্যালকোহল বাষ্প হয়ে উবে যাব। এরপর পিটুইটারি গ্রন্থিগুলি একটি টিসু হোমোজেনাইজার (Tissue ho- mogenizer) টিউবে রাখা হয়। সামান্য। পরিমাণ পাতিত জল বা 0.3% সাধারণ লবণ দ্রবণ (normal salt solution) ওই টিউবে রেখে পেষক দণ্ড দ্বারা গ্রন্থিগুলিকে ভালোভাবে পেষণ কর হয়।
এর ফলে গ্রন্থি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে টিউবের নীচে জমা হয় এবং উপরিতলে ঘোলা দ্রবণ থাকে। এই ঘোলা দ্রবণের সাথে প্রয়োজন মতো পাতিত জল মিশিয়ে সেন্ট্রিফিউজ টিউবে ঢালা হয়। প্রতি মিনিটে 2000 বার ঘোরে (2000rpm) এমন একটি সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্রে (Centrifuse apparatus) 5 মিনিট ধরে ওই দ্রবণটি ঘোরানো হয়। সেন্ট্রিফিউজের পর টিউবের নীচের দিকে জমা হয় গ্রন্থির অতিশয় ক্ষুদ্র অংশ এবং উপরিভাগে থাকে স্বচ্ছ দ্রবণ। এহেন স্বাচ্ছ দ্রবণই পিটুইটারি নির্যাস (Pituitary extract) বা হরমোন গোলা জল এবং ইহাই প্রণোদিত প্রজননে ইনজেকশনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
পিটুইটারি নির্যাসের সংরক্ষণ (Preservation of pituitary extract)
পিটুইটারি নির্যাস প্রস্তুতির ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ইনজেকশনের জন্য এটি ব্যবহার করা হলে ভালো ফল পাওয়া যায়। অন্যথায় বিশুদ্ধ গ্লিসারিনের সঙ্গে মিশ্রিত করে সংরক্ষণ করা যায়। সেক্ষেত্রে এক ভাগ হরমোন গোলা জল (পিটুইটারি নির্যাস) ও দুইভাগ খাঁটি গ্লিসারিন সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্র দ্বারা ভালোভাবে মিশিয়ে নেওয়া হয় এবং টিউবের উপরিভাগের দ্রবণকে কাচের অ্যাম্পুলে (ampule) ভরে সিল করে রাখা হয়। এইরূপে প্রস্তুত অ্যাম্পুল ফ্রিজে রেখে দিলে প্রায় দুই মাস এর কার্যক্ষমতা বজায় তাকে। বর্ষা আরম্ভের পূর্বে পিটুইটারি নির্যাস সংরক্ষণ করলে ভালো হয়।
মাছের দেহ ওজনের প্রেক্ষিতে পিটুইটারি নির্যাসের মাত্রা নির্ধারণ (Determination of dose of pituitary extract in relation to the body weight of fish)
প্রণোদিত প্রজননের সার্বিক সাফল্য নির্ভর করে কতকগুলি ফ্যাক্টরের উপর। এদের মধ্যে অন্যতম হল নির্ধারিত মাত্রা অপেক্ষা বেশি বা কম মাত্রায় পিটুইটারি নির্যাস প্রয়োগ করলে সাফল্য আসবে না। কার্পের ক্ষেত্রে স্ত্রী মাছকে দুবার এবং পুরুষমাছকে একবার পিটুইটারি পিটুইটারি নির্যাস ইনজেক্ট করতে হয়। প্রথমে স্ত্রীমাছকে প্রতি কেজি দেহ ওজনের সাপেক্ষে 1-1.5 mgm ইনজেক্ট করা হয়। এর 4-5 ঘণ্টা পর পুনরায় স্ত্রী মাছকে প্রতি কেজি দেহ ওজনের সাপেক্ষে 8-10 mgm হারে দ্বিতীয় বার ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। এটি নির্ভর করে জলের তাপমাত্রা, জলে খনিজ পদার্থের উপস্থিতি, আবহাওয়া এবং ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণুর পরিস্ফুরণের দশার উপর। স্ত্রী মাছকে দ্বিতীয়বার ইনজেকশন দেওয়ার সময়ই পুরুষ মাছকে মাত্র একবার, প্রতি কেজি দেহ ওজনের সাপেক্ষ 1-2 mgm ইনজেক্ট করা বাঞ্ছনীয়। ইনজেকশন পর্ব শেষ হওয়ার পর দুইটি পুরুষ মাছ তিনটি স্ত্রী মাছ হাপায় (breeding hapa) ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইনজেকশন প্রয়োগ |
বিদেশাগত কার্পের মধ্যে সাইপ্রিনাস কার্প প্রণোদিত প্রজনন ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে আবদ্ধ জলাশয়ে ডিম পাড়ে। কিন্তু গ্রাস কার্প ও সিলভার কার্পের ক্ষেত্রে প্রণোদিত প্রজননের মাধ্যমে ডিমপোনা সংগ্রহ করা হয়। গ্রাস কার্পের প্রাণাদিত প্রজনন দেশজ মেজর কার্পের অনুরূপ। সিলভার কার্পের ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন পদ্ধতি অর্থাৎ শুষ্ক নিঃসরণ (dry stripping) পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে।এক্ষেত্রে প্রথমে স্ত্রী মাছের পেটে ধীরে ধীরে চাপ দিয়ে ডিম্বাণু বার করে একটি শুষ্ক এনামেল ট্রের ওপর রাখা হয়। সঙ্গে সঙ্গে একটি পুরুষ মাছের পেটে চাপ দিয়ে নির্গত শুক্রাণুগুলিকে (semen বা milt) ডিম্বাণুগুলির ওপর ফেলা হয়। প্রয়োজন বোধে একইভাবে আর একটি পুরুষ মাছের শুক্রাণু ফেলা হয়। অতঃপর পাখির পালকের সাহায্যে সন্তর্পণে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুগুলিকে মেশানো হয়। কয়েক মিনিট পর (প্রায় ২ মিনিট) ডিম্বাণুগুলি নিষিক্ত হলে ধীরে ধীরে ট্রেতে জল ঢেলে নাড়ানো হতে থাকে। পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে নিষিক্ত ডিমগুলি স্বচ্ছ হয়ে আকারে বড়ো হয়, অন্যদিকে অনিষিক্ত ডিমগুলি অস্বচ্ছ হয় এবং এদের বৃদ্ধি ঘটে না। নিষিক্ত ডিমগুলি সংগ্রহ করে হ্যাচিং হাপায় (hatching hapa) স্থানান্তরিত করা হয়।
ইনজেকশনের পদ্ধতি ও সময়সূচি (Injection technique and timing of injection)
মাছের দেহপেশিতে (Intramuscular) কিংবা দেহগহ্বরে (Interperitoneum) ইনজেকশন প্রয়োগ করা যেতে পারে। তথাপি দেহপেশিতে ইনজেক্ট করার প্রথা অনেক বেশি প্রচলিত। সাধারণত দেহ ও পুচ্ছ পাখনার সংযোগস্থলে (Caudal peduncle) একটি আঁশ সামান্য তুলে, ইনজেকশনের সূচ (needle) ঢুকিয়ে দেহ পেশিতে ইনজেকশন দেওয়া হয়। অবশ্য পৃষ্ঠ পাখনার (dersal fin) গোড়ার পেশিতে ইনজেক্ট করা যেতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই পার্শ্বীয় স্পর্শেন্দ্রিয় রেখায় (lateral line of sense organ) যেন ইনজেকশনের সূচ বিদ্ধ না হয়। স্ত্রী মাছের ক্ষেত্রে দুইবার প্রয়োগ কালে দেহ দুই পার্শ্ব বেছে নিতে হবে, এক পার্শ্বে দুইবার নয়। মাছের পুচ্ছ দেহ ওজনের পাখনা তারতম্যে বিভিন্ন মাপের সূচ ব্যবহা করা হয়। 2-3 কেজি ওজনের মাছের জন্য BDH No. 22 সূচ এবং 3 কেজির বেশি ওজনের মাছের ক্ষেত্রে BDH No. 19 সূচ ব্যবহৃত হয়। ইনজেকশন দেওয়ার সময় সূচটি মোটামুটি দেহের সঙ্গে 45° কোণ (angle) করে পিটুইটারি নির্যাস দেহ পেশিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
ব্রিডিং হাপায় ডিমের নিষিক্তকরণ (Fertilization of eggs in breed- ing hapa)
ইনজেকশন পর্ব শেষ হবার পর দুটি পুরুষ মাছ ও তিনটি স্ত্রী মাছকে একত্রে একই ব্রিডিং হাপায় ছেড়ে দেওয়া হয়। ব্রিডিং হাপায় 6-7 ঘণ্টা যৌন উত্তেজক ক্রিয়ার (sport) পর স্ত্রী মাছ ডিম ছাড়ে ও পুরুষ মাছ শুক্রাণু নির্গত করে। এক একটি ডিম্বাণু একটি করে শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়। এই সময় কালে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। তার জন্য ফোয়ারার সাহায্যে অনবরত জল প্রবাহ বাজায় রাখা একান্ত আবশ্যক।অনিষিক্ত ডিম এবং নিষিক্ত ডিম চেনার সহজ উপায় হল- (ⅰ) অনিষিক্ত ডিম তুলনামূলকভাবে ছোটো ও অস্বচ্ছ প্রকৃতির। (ii) নিষিক্ত ডিম অপেক্ষা বড়ো ও স্বচ্ছ প্রকৃতির।তাছাড়া নিষিক্ত ডিম জল শোষণ করে শক্ত হয় এবং ব্রিডিং হাপার তলদেশে জমা হয়।
মার্কিন কাপন বা সূক্ষ্ম নাইলন সুতো দিয়ে তৈরি যে আধার জলের মধ্যে টাঙালে বড়ো চৌবাচ্চা তৈরি হয়, তাকে হাপা (hapa) বলে। হাপা প্রকৃতপক্ষে জলে উলটোভাবে টাঙানো মশারি। মাছের প্রজনন কাজের জন্য নির্মিত হাপাকে ব্রিডিং হাপা (breeding hapa) বলে। ব্রিডিং হাপা সাধারণ হাপার মতো হলেও এর ওপরের খোলা দিকটা কাপড় দ্বারা এমনভাবে ঢাকা থাকে যাতে ওপরের আচ্ছাদন ঢাকনার কাজ করে এবং প্রয়োজনবোধে এই আবরণ খোলা ও বন্ধ করা যায়। পরিণত মাছের দেহ ওজনের উপর ব্রিডিং হাপার আয়তন নির্ভর করে। 2-3 কেজি ওজনের মাছের জন্য 2.4 মিটার × 1.2 মিটার × 1.0 মিটার। এই ধরনের হাপার চার কোণে বাঁশের খুঁটির সাহায্যে হাপাটি পুকুরে স্থাপন করা হয়। লক্ষ রাখতে হবে হাপার তলদেশ যেন পুকুরের তলদেশের মাটি স্পর্শ না করে এবং উপরি অংশ জলের ওপরের তল থেকে 15-20 সেমি উঁচুতে থাকে।
হাপা |